পাচার চলছেই, হুঁশ নেই কারও

পুলিশ প্রশাসনের উপর ভরসা হারিয়েছে অনেক আগেই। পাচার রুখতে তাই নিজেরাই রাত পাহারা দেওয়ার কাজ শুরু করেছিলেন চাপড়ার রাঙিয়াপোতার লোকজন। ফলও মিলেছিল হাতেনাতে। শনিবার ভোরে ধরা পড়েছে পাচারের উদ্দেশে নিয়ে যাওয়া ১৮টি গরু-মোষ। তারপর থেকে শুরু হয় নতুন বিপত্তি।

Advertisement

সুস্মিত হালদার ও সুদীপ ভট্টাচার্য

চাপড়া শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০১৫ ০০:২৮
Share:

গ্রামবাসীদের হাতে ধরা পড়া মোষ।

পুলিশ প্রশাসনের উপর ভরসা হারিয়েছে অনেক আগেই। পাচার রুখতে তাই নিজেরাই রাত পাহারা দেওয়ার কাজ শুরু করেছিলেন চাপড়ার রাঙিয়াপোতার লোকজন। ফলও মিলেছিল হাতেনাতে। শনিবার ভোরে ধরা পড়েছে পাচারের উদ্দেশে নিয়ে যাওয়া ১৮টি গরু-মোষ। তারপর থেকে শুরু হয় নতুন বিপত্তি। আটকে রাখা ওই গবাদি পশু ছেড়ে দেওয়ার জন্য অচেনা ফোন নম্বর থেকে মাঝেমধ্যেই হুমকি আসছে। বলা হচ্ছে, ‘‘হয় গরু-মোষ ছাড়, না হলে বেঘোরে প্রাণটা দেওয়ার জন্য তৈরি থাক।’’

Advertisement

সীমান্তঘেঁষা রাঙিয়াপোতা এলাকা দিয়ে গরু পাচার নতুন কিছু নয়। তবে সম্প্রতি পাচারের রমরমা বেড়েছে। পাচার হওয়া গবাদি পশুর পায়ের চাপে নষ্ট হচ্ছে বিঘের পর বিঘে জমির ফসল। অভিযোগ, পুলিশ, বিএসএফ ও স্থানীয় ব্লক প্রশাসনকে জানিয়েও কোনও ফল মেলেনি। তারপর নিজেদের ফসল বাঁচাতে ও পাচার রুখতে গ্রামের বাসিন্দারা রাত পাহারা শুরু করেন। কিন্তু গরু-মোষগুলি আটকে দেওয়ার পরে যে ভাবে হুমকি দিয়ে পাচারকারীদের ফোন আসছে তাতে রীতিমতো নিরাপত্তহীনতায় ভুগছেন গ্রামের বাসিন্দারা। তাঁদের প্রশ্ন, ‘‘এ ভাবে আর কত দিন? প্রশাসন সব জেনেও ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে রয়েছে। আমরা কিছু করতে গেলেও কেউ আমাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে না। আমরা তাহলে যাব কোথায়?’’

কোনও রাখঢাক না করেই পুলিশ প্রশাসনের উপর ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন সিপিএমের গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্যার স্বামী শঙ্কর সাঁতরা। তিনি বলেন, ‘‘প্রতি মুহূর্তে আমাদের প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। পাচারকারীদের ভয়ে গ্রামের বাইরে পা রাখতে ভয় পাচ্ছেন অনেকেই। আমরা দীর্ঘদিন ধরেই পুলিশ, প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে জানিয়ে এসেছি। কিন্তু কোনও প্রতিকার পাইনি।’’

Advertisement


পাচার করা গবাদি পশুর পায়ের চাপে এ ভাবেই নষ্ট হয় খেতের ফসল।

শঙ্করবাবু জানান, বিএসএফকে কিছু বললে তারা পুলিশের দিকে আঙুল তোলে। বলে, পুলিশ আটকায় না বলেই তো এক সঙ্গে এত গরু সীমান্তে আসে। তিনি বলেন, ‘‘বিএসএফের দোষ আছে ঠিকই। কিন্তু এই কথাতেও যুক্তি রয়েছে। দিনে দুপুরে পায়ে হেঁটে, গাড়িতে করে শয়ে শয়ে গরু এতগুলো থানার উপর দিয়ে আসছে। অথচ পুলিশ তাদের আটকাচ্ছে না। আর আটকায় না বলেই তো গরু-মোষ সীমান্ত পর্যন্ত আসতে পারে।’’ একই সুর বিএসএফের ডিআইজি পুস্পেন্দর সিংহ রাঠোর-এর গলাতেও। তিনি বলেন, ‘‘জওয়ানেরা পাহারা দেয় বলেই প্রতিদিন এত গরু ধরা পড়ছে। গরু পাচার ঠেকাতে দিয়ে জখম হচ্ছে জওয়ানরা। এত বড় একটা ফাঁকা বর্ডার। তা সত্ত্বেও ঝুঁকি নিয়ে পাহারা দেয় তারা।’’ তিনি বলেন, ‘‘পুলিশ কী করছে? কী ভাবে এক গরু সীমান্তে চলে আসছে? পুলিশ কেন আটকাচ্ছে না?’’

চাপড়ার রাঙ্গিয়ারপোতা, হুদোপাড়া ও মহখোলা গ্রামের প্রায় ১৫ কিলোমিটার এলাকায় কোনও কাঁটাতারের বে‌ড়া নেই। আর সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ওই এলাকা দিয়ে অবাধ গরু পাচার করে পাচারকারীরা। গ্রামবাসীদের কথায়, প্রতিদিন রাতে শিমুলিয়া, বাগানেপাড়া, এলাঙ্গির মতো বেশ কিছু এলাকায় শয়ে শয়ে গরু এনে জড়ো করা হয়। তারপর ‘সিগন্যাল’ পেলে সেই গরু-মোষ বাগদারবিল, গড়ারবিল, প্রতাপতলার বিল বা জলঙ্গিতলার বিলের খেতের উপর দিয়ে তাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে ‘বর্ডার রোড’ পার করে বাংলাদেশে পাচার করা হয়। এ দিকে, শয়ে শয়ে গরুর পায়ের চাপে নষ্ট হচ্ছে খেতের পাট, ধান। হাজার হাজার টাকা খরচ করে চাষ করলেও গরু পাচারকারীদের অত্যাচারে লাভের গুড় মাঠেই মারা যাচ্ছে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, পুলিশ, বিএসএফ ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের একাংশের মদতে দিনের পর দিন গরুপাচার চালিয়ে যাচ্ছে দুষ্কৃতীরা। তাই বার বার অভিযোগ জানিয়েও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তাই নিজেরাই এককাট্টা হয়ে নেমে পড়েছিলেন রাত পাহারায়। গ্রামের ২৫ থেকে ৩০ জ‌নের একটি দল হাতে লাঠি-ইট নিয়ে রাত পাহারা দেন। সন্দেহজনক কিছু দেখলে চিৎকার করবেন। গ্রামবাসীরা তাই শুনে মুহূর্তে ঘটনাস্থলে ছুটে যান। সেই মতো শনিবার ভোরে পাহারাদারদের চিৎকার শুনে ছুটে যান অনেকেই। একসঙ্গে এত গ্রামবাসীকে দেখে গরু ফেলে পিঠটান দেয় পাচারকারীরা। পাচারকারীদের ফেলে যাওয়া ১৪টি মোষ ও ৪টি গরু ধরে ফেলেন। তারপর থেকে শুরু হয়েছে হুমকি আসার পালা।

শনিবার ভোরে পাহারায় ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা মিঠুন বাগও। তিনি জানান, বেশ কিছু লোকজন ‘চোর চোর’ বলে চিৎকার করছিলেন। সেই শুনে তাঁরা ছুটে যান একেবারে সীমান্তে। সেখানে তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা গরু-মোষগুলিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন। একটু দূরেই দাঁড়িয়েছিল পাচারকারীরা। তাঁদের যেতে দেখেই তারা চম্পট দেয়।

মাস কয়েক আগে গরুপাচার আটকাতে গিয়ে পাচারকারীদের হাতে আক্রান্ত হয়ে ছিলেন বিএসএফের ১১৩ নম্বর ব্যাটেলিয়নের ইন্সপেক্টর চন্দ্রবীর সিংহ। পাচারকারীদের মোকাবিলা করা যে সহজ হবে না তা হাড়েহাড়ে জানেন রাঙিয়াপোতার মানুষ। তবে যতই হুমকি আসুক পিছিয়ে আসার কথা ভাবছেন না কেউই। গ্রামেরই পঞ্চায়েত সদস্য তৃণমূলের বাবুল বাগচী। এ দিন তিনি ঘটনার খবর শুনেই তড়িঘড়ি ছুটে যান রাঙিয়াপোতায়। তাঁর অভিযোগ, ‘‘বিএসএফ ও পুলিশের মদতেই এই পাচার চলছে। বহু বার বিষয়টি তাদের জানানো হয়েছে। জানানো হয়েছে তৃণমূলের স্থানীয় বিধায়ককেও। কিন্তু রহস্যজনক ভাবে কেউই পাচার রুখতে কোনও পদক্ষেপ করেনি।’’

তবে তাঁর কথায়, ‘‘রাত পাহারা তো দিতেই হবে। না হলে যে ফসল বাঁচবে না। গরু পাচারের জন্য বিঘের পর বিঘে মাঠের ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’’ মহেশপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের ওই সদস্যের কথায়, ‘‘ফসলের খেত বাঁচাতে না পারলে তো আমাদের এমনিতেই না খেয়ে মরতে হবে। তাই গ্রামের সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যেমন করেই হোক এই গরুপাচার বন্ধ করতে হবে।’’

পুলিশ সুপার ভরতলাল মিনা বলেন, ‘‘গোটা বিষয়টি ভাল করে খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ যদিও এমন আশ্বাসে বিশেষ ভরসা পাচ্ছে না রাঙিয়াপোতা।

চাপড়ার রাঙিয়াপোতায় তোলা নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন