কম্বলের উত্তাপে উধাও ধুনুরির ওম

দৌলতাবাদের কলাডাঙা-ঘোষপাড়ার ছুঁয়ে ভৈরবের গা ঘেঁষে চলে গিয়েছে ইরাজি ‘টি’ আকৃতির একটি বিশাল গ্রাম। গ্রামের শিশির ভেজা হেমন্তের সকালে ওই রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে চলছেন ‘আকবরের বাপ’। সঙ্গে আকবর।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

বহরমপুর শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৮ ০২:২৮
Share:

তুলো-ঝাড়াই: বহরমপুরে। নিজস্ব চিত্র

দৌলতাবাদের কলাডাঙা-ঘোষপাড়ার ছুঁয়ে ভৈরবের গা ঘেঁষে চলে গিয়েছে ইরাজি ‘টি’ আকৃতির একটি বিশাল গ্রাম। গ্রামের শিশির ভেজা হেমন্তের সকালে ওই রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে চলছেন ‘আকবরের বাপ’। সঙ্গে আকবর।

Advertisement

আকবরের বাপের ঘাড়ে ধুন। বাঁশ ফাটিয়ে তৈরি তেল চুকচুকে দু’টো লম্বা লাঠি তাঁর হাতে। মুখে তাঁর সুরেলা হাঁক, ‘‘লেপ, তোশক তৈরি করবেন গো... লোপ তোশক।’’ এখন সেই ধুলো ধূসরিত গ্রামের রাস্তায় পড়েছে পিচ-পাথর। আজ আর সেই আকবর নেই। তাঁর বাবাও নেই। নেই মানে, কয়েক বছর ধরে শীতের পরিযায়ী পাখির মতো নওদাপাড়ায় তাঁরা আর আসেন না। তাঁদের বাড়ি সাবেক ঝাড়খণ্ডে। তাঁরা আসতেন শীত থেকে বাংলার মানুষকে বাঁচাতে। লেপের পাশাপাশি তোশক তৈরি করাও ছিল তাঁদের পেশা। ‘ব্ল্যাঙ্কেট’ আর নামীদামি কোম্পানির তোশক তাঁদের সেই পেশা কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু সেই স্মৃতিটুকু রয়ে গিয়েছে।

‘আকবরের বাপ’ মানে আবুল কাশেম তাঁর ছেলের হাত ধরে শীত পড়ার আগেই হেমন্তের মাঝামাঝি পৌঁছে যেতেন নওদাপাড়ায়। কোনও বার তাঁরা আশ্রয় নিতেন হাজি নৈমুদ্দিনের বৈঠকখানায়। কোনও বার উঠতেন আজাহার আলির বৈঠকে। ইট দিয়ে তৈরি অস্থায়ী উনুনে তাঁরা রাতের বেলায় ভাত ফুটিয়ে নিতেন। সেই ভাত রাতে খেতেন। পর দিন সকালেও সেই কড়কড়ে ভাত খেয়ে ধুনি ঘাড়ে বেরিয়ে পড়তেন বাপ-ছেলেতে।

Advertisement

নওদাপাড়ার গ্রামের আব্দুল গফফর বলেন, ‘‘তাঁরা কারও বাডির ছাদে, কারও বাড়ির উঠোনে যত্ন করে খেজুর পাতার পাটি পাততেন। কাশেম গামছা দিয়ে নিজের নাক, কান ও মাথা পেচিয়ে ঢেকে দিয়ে আঁটোসাঁটো করে বাঁধতেন। নিজের ছেলেরও নাক, কান গামছা দিয়ে পরিপাটি করে বেঁধে দিতেন।’’ ওজন করে সেই পাটিতর উপর তুলো রাখা হত। প্রথমে হাত দিয়ে সেই তুলো টুকরো করার পর লাঠি দিয়ে সপাসপ আওয়াজ করে জোরে জোরে মারতেন ধুনুরিরা।

তারপর ছিল আসল খেল। তুলোর গাদার এক প্রান্ত থেকে ধুনির ছিলায় আঘাত করে তুলো ধোনার কাজ শুরু হত। তুলো ভাল ভাবে ধোনার পর শরতের সাদা মেঘের মতো পেঁজা আকার নেয়। তখন নতুন কাপডের খোলের ভিতর তুলো ঢোকানো হয়।

বড়সড় সুচের ভিতর মোটা সুতো ঢুকিয়ে নিপুণ হাতে সেলাই শুরু করা হয়। দামি না সস্তা, মার্কিন না ফুলবাহারি— কোন কাপড়ের লেপ-তোশক হবে, সেই লেপের গায়ে সেলাই ফুঁড়ে নকশার হিল্লোল উঠবে কি না তা সবই নির্ভর ধুনুরির হাতের জাদুর উপরে।

দামি ব্র্যান্ডের তোশক, গদি, কম্বলের শাসনে কোথায় গেলেন তাঁরা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন