কয়েন কিস‌্সা

আটপৌরে হোলুই গানেও বাঁধা পড়ল খুচরো-কাহন

এ গান নদিয়ার নিজস্ব লোকগান ‘হোলুই’। গ্রামীণ মানুষের দিনযাপনের নানা সমস্যার কথা গান গেয়ে তুলে ধরা হোলুই গায়কদের প্রথা। যেমন এ বার উঠে এসেছে খুচরো সঙ্কটের কথা। খুচরো না নিলে খরিদ্দার ফিরবে আর নিলে ফেরাবে শহরের মহাজন।

Advertisement

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০১৮ ০১:০৭
Share:

কয়েন-কাহিনি শেষতক হোলুইয়ের সুরেও দিব্যি জায়গা করে নিল। গেরস্তের হেঁশেল থেকে আটপৌরে মুদিখানার বয়াম উজিয়ে সে এখন গাইছে— ‘শুনুন শুনুন বঙ্গবাসী, শুনুন দিয়া মন/আজ এই আসরে খুচরো পয়সার কথা করিব বর্ণন’। কৃষ্ণগঞ্জের নিকোনো উঠোনে জমে উঠেছে গানের আসর। গায়ক, বাদক মিলিয়ে জনা পাঁচেক লোক। চড়া স্কেলে বাঁধা হারমোনিয়ামে মূল গায়েন ধরেছেন—‘শুনুন শুনুন বঙ্গবাসী, শুনুন দিয়া মন/আজ এই আসরে খুচরো পয়সার কথা করিব বর্ণন/খুচরো পয়সা বাজারেতে যেই না ছেয়ে গেল/ছোট ছোট দোকানদার বিপদে পড়িল।’ এতক্ষণ যাঁরা খোল-করতাল বাজাচ্ছিলেন তাঁরা এ বার ধুয়ো ধরলেন—‘আহা বিপদে পড়িল।’ নিত্য হেনস্তা যেন সাঁঝের বাতাসে রিনরিনে সুর ধরে রাখছে।

Advertisement

খোল করতালের দাপট কমতেই গায়েন ফের ধরলেন—‘মহাজনের ঘরে গেলে নেয় না পয়সা ভাই/ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এখন বিপদে পড়েছে তাই/এই আসরে সবার কাছে অনুরোধ জানাই/পাঁচ-দশ টাকার নোট দিয়া সাহায্য করো ভাই।’ কথাগুলো ঘুরে ফিরে দু-তিন বার করে গেয়ে সমের মুখে আসতেই উপস্থিত সকলে মিলে একসঙ্গে ধ্বনি দিয়ে উঠলেন— ‘হোলবোল হোলবোল।’

এ গান নদিয়ার নিজস্ব লোকগান ‘হোলুই’। গ্রামীণ মানুষের দিনযাপনের নানা সমস্যার কথা গান গেয়ে তুলে ধরা হোলুই গায়কদের প্রথা। যেমন এ বার উঠে এসেছে খুচরো সঙ্কটের কথা। খুচরো না নিলে খরিদ্দার ফিরবে আর নিলে ফেরাবে শহরের মহাজন। এই উভয়সঙ্কটে রুটিরুজি বন্ধ হওয়ার জোগাড় গ্রামীণ ব্যবসায়ীদের একাংশের। এ বারে হোলুই গায়কেরা তাই গানের বিষয় করেছেন খুচরো সঙ্কট।

Advertisement

এ গানের পোশাকি নাম হোলুই হলেও কেউ কেউ গানের শেষ চরণ অনুসারে ‘হোলবোল’ বলেন। শুরুতে কৃষ্ণকথা দিয়ে শুরু হলেও এ গানের আসল আকর্ষণ কিন্তু সমকালে ঘটে চলা নানা অন্যায়, অবিচার। আড়ালে নয় সমস্যার কথা অকপটে বলাটাই হোলুইয়ের বিশেষত্ব। নোট বাতিল থেকে নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর থেকে কামদুনি চিটফান্ড, নানা সময়ে নারী নির্যাতন ঘুরে সে এখন কয়েনে এসে থমকে গিয়েছে।

শুরুটা মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে। শীতকাল এলেই নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জ, শিবনিবাস, কৃষ্ণপুরের মতো চূর্ণিতীরের গ্রামগুলি মেতে ওঠে হোলুই গানে। সারা পৌষমাস বাড়ি বাড়ি ঘুরে গাওয়া হয়।

কিন্তু কারা বাঁধেন এ সব গান? গায়কই বা কারা? মূল গায়কদের এক জন, নারায়ণচন্দ্র ঘোষ জানান, এ গান আদতে রাখালিয়া গান। শুরুতে গ্রামের রাখাল বালকেরা সন্ধ্যার পর গাঁয়ের বাড়ি বাড়ি ঘুরে গাইত কৃষ্ণকথা, পৌরাণিক উপাখ্যান। সময়ের বদলের সঙ্গে গানের ভাবেরও বদল হয়। সমকালীন নানা বিষয় নিয়ে গান বাঁধা শুরু হয়। গ্রাম-জীবনের নানা রোজনামচা থেকে পণপ্রথা সবই হয়ে ওঠে হোলুই গানের বিষয়। নারায়ণচন্দ্র ঘোষ ছাড়াও নিত্যগোপাল ঘোষ, বসুদেব ঘোষের মতো সকলেই বাপ-ঠাকুর্দার উত্তরাধিকার হিসাবে বয়ে চলেছেন এ গান।

(শেষ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন