মানি বাতিল। পড়ে রইল মানিব্যাগ। —দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
আলমারির তাকে সাজানো রয়েছে পেন, খাতা, রং পেনসিল। সামনের কাচের উপরে সাঁটানো স্টিকার। সেখানে লাল কালিতে লেখা ছিল—‘ধার চাহিয়া লজ্জা দেবেন না’। ‘ছিল’ কেন? কারণ, এখন নেই। বেথুয়াডহরির সুজিত বিশ্বাস সেই স্টিকারের উপরে সাদা কাগজ সেঁটে দিয়েছেন।
বেলডাঙার মুদির দোকানি সনাতন দাস এত দিন কেউ ধার চাইলেই শুনিয়ে দিতেন, ‘‘আজ নগদ, কাল ধার।’’ আর এখন? সেই দোকানেরই মালিক হাসতে হাসতে বলছেন, ‘‘আরে দাদা, আপনি কি আমার আজকের খদ্দের? যা লাগবে নিয়ে যান। পরে দিয়ে দেবেন।’’
পাঁচশো ও এক হাজার টাকার নোট বাতিল ঘোষণার পরে এ ভাবেই চলছে গাঁ-গঞ্জ কিংবা শহরের বেশ কিছু বাজার। ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, ৮ নভেম্বর রাতে নোট বাতিলের খবর পেয়ে পরের দিন সকাল থেকে তাঁরাও ক্রেতাদের কাছ থেকে পাঁচশো ও এক হাজার টাকার নোট নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে যা পরিস্থিতি তৈরি হয়, তাতে ব্যবসা শিকেয় ওঠার জোগাড় হয়েছিল। কারণ, কেউই দোকানমুখো হচ্ছিলেন না।
তারপরেই দুই জেলার বহু ব্যবসায়ী ক্রেতাদের ধার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এর আগে যে ধার-বাকিতে কারবার চলত না, এমন নয়। কিন্তু যেচে এ ভাবে ক্রেতাদের ধার দেওয়া? নাহ্, বহু প্রবীণ ব্যবসায়ীও মনে করতে পারছেন না। আর ক্রেতারাও খুশি। কারণ, এই নোটের আকালে এমন সুযোগ পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা। তবে ব্যাঙ্ক, ডাকঘর ও এটিএমের পরিষেবা দ্রুত স্বাভাবিক না হলে এই ধারের কারবারও যে কতদিন চলবে তা নিয়েও উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা।
রানাঘাট বেলতলা বাজারে মুদিখানার দোকান উত্তম বিশ্বাসের। দীর্ঘ দিন ধরে সেখান থেকেই বাজার করেন কুমুদনগরের পিন্টু দাস। গত কয়েক দিনে তিনিও নোট নিয়ে নাজেহাল। পকেটে রয়েছে পাঁচশো ও এক হাজারের নোট। কিন্তু নেওয়ার লোক নেই। হাট-বাজার করবেন কী করে? শেষ পর্যন্ত মুশকিল আসান করে দেন উত্তমবাবু। তিনি বলছেন, ‘‘পিন্টুবাবুর মতো অনেককেই বলেছি, যা লাগবে নিয়ে যেতে। পরে সমস্যা মিটে গেলে তাঁরা শোধ করে দেবেন।’’ আর পিন্টুবাবু বলছেন, ‘‘এই দুঃসময়ে উত্তমদা যা করলেন তা সারা জীবন মনে থাকবে।’’
ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, কৃষ্ণনগর, কল্যাণী, নবদ্বীপ, বহরমপুরের মতো বেশ কিছু এলাকায় প্লাস্টিক কার্ডে কেনাকাটার সুবিধা রয়েছে। কিন্তু সর্বত্র তো আর সেই ব্যবস্থা নেই। ফলে ক্রেডিট কার্ড ছাড়াই ধার দিতে হচ্ছে। পুজো ও রাস চলছে। সামনে বিয়ে। ফলে ধার না দিলে সকলেই সমস্যায় পড়বেন। রঘুনাথগঞ্জের এক মনোহারি দোকানে হাজার টাকার নোট দিতে চেয়েছিলেন স্থানীয় এক ক্রেতা। দোকানের মালিক নন্দ চট্টোপাধ্যায় অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলছেন, ‘‘আরে দাদা, আপনার যা দরকার নিয়ে যান। টাকা পরে দেবেন। কিন্তু বাতিল নোট নিতে বলবেন না, প্লিজ।’’
কিন্তু এ ভাবেই বা কতদিন চলবে?
রঘুনাথগঞ্জের এক দোকানের মালিক রঞ্জিত রায় বলছেন, ‘‘যতদিন মহাজন দরাজ থাকবে। কারণ, মহাজনও এখন আগের মতো আমাদের তাগাদা দিচ্ছে না। সকলকেই তো ব্যবসা করতে হবে!’’ বহরমপুরের রানিবাগান মোড়ের একটি দোকানে বড় হরফে এখনও লেখা রয়েছে— ‘ধার চাহিয়া লজ্জা দিবেন না’। কিন্তু সেই সেই অমোঘ বাণীও এখন যেন দোকানের মালিককে ভেংচি কাটছে। দোকান মালিক প্রতুল পোদ্দার বলছেন, ‘‘একশো টাকার নোটের আকালে গত কয়েক দিন ধরে এত জনকে ধার দিতে হয়েছে যে হিসেব রাখতে নতুন খাতা পর্যন্ত কিনতে হয়েছে।’’
তবে সবাইকে যা ধার দিতে হচ্ছে, এমনও নয়। কোনও কোনও ব্যবসায়ী এখনও পাঁচশো ও এক হাজার টাকার নোট নিচ্ছেন। তাঁদের কথায়, ‘‘আমাদের কাছেও তো ওই নোট রয়েছে। সেগুলোও তো ব্যাঙ্কে গিয়ে বদলে আনতে হবে। তখন না হয় আরও কিছু টাকা বাড়বে। সরকার তো নোট বদলানোর জন্য বেশ কিছু দিন সময় দিয়েছে। ফলে এই নোটগুলো না নেওয়ার তো কোনও কারণ নেই।’’
খুচরোর আকালে অনেকে আবার পাঁচশো বা হাজার টাকার নোট নিয়ে জমা রাখছেন। ক্রেতারা জিনিসপত্র যা নিচ্ছেন, সেই টাকা থেকে কেটে নেওয়া হচ্ছে। হিসেব রাখা হচ্ছে খাতাতেই। অনেকটা প্রিপেড মোবাইলের মতো। টাকা শেষ। ফের পাঁচশো কিংবা হাজার টাকার নোট। প্লাস্টিক কিংবা ক্রেডিট কার্ড ছাড়াই দিব্যি বিকোচ্ছে ঘি থেকে ঘট সবকিছুই।