শিশুটিকে কোলে নিয়ে শান্তিপুর হাসপাতালে। — নিজস্ব চিত্র
সরকারি হাসপাতালের রং চটা বেড ফুঁড়ে ওয়ার্ডের এক ফালি রাস্তাটা দিয়ে যাওয়ার সময়ে ডাকটা ঘুরে ফিরে আসবেই— ‘সুনুউউউ’।
যেই ডাকুক, সদ্য হামায় অভ্যস্থ বাচ্চাটা সাড়াও দেবে, কখনও হেসে কখনও বা আকুম-বাকুম শিশু গদ্যে।
ডিউটিতে এসে এক বার অন্তত তাকে দেখে যাচ্ছেন না, এমন চিকিৎসক নেই। আর খটখটে হিলের কাঠখোট্টা নার্স থেকে আয়া মাসি— ‘‘ওঁদের কড়ে আঙুল ধরেই তো বড় হচ্ছে ও’’, ন’মাস ধরে শান্তিপুর হাসপাতালের বেডে ঘোর অস্বস্তি নিয়ে পড়ে থাকা মহিলা বিড় বিড় করছেন।
শাড়ির খুঁটে চোখ মুছে আক্ষেপ করছেন, ‘‘নিজের মেয়েকে ঘরে তুলতেও আর কত প্রমাণ যে দিতে হবে!’’ আপাতত, আইনের অনুশাসনে থম মেরে আছে শুধু সময়।
চলতি বছরের গোড়ার কথা।
ট্রেনের কামরায় কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছে শিশুটি। কিন্তু সঙ্গে যে ‘মা’, বাচ্চা ভোলানোর রকমসকমই তো জানেন না তিনি।
সন্দেহ হওয়ায়, ট্রেনের কামরায় থাকা স্কুল ফেরত এক ঝাঁক শিক্ষিকা মহিলাকে শুরু করেছিলেন জেরা। প্রশ্নে জেরবার সেই মহিলা কবুল করেছিলেন এ তার নিজের মেয়ে নয়। ট্রেন শান্তিপুরে আসতেই সেই নকল মা-সহ শিশুটিকে তাঁরা তুলে দিয়েছিলেন রেল পুলিশের হাতে।
আদালত ঘুরে অতঃপর, শিশুটির ঠাঁই হয়েছিল শান্তিপুর স্টেট জেনারেল হাসপাতালে। তলব হয়েছিল আসল মায়েরও, উলুবেড়িয়া থেকে সেই মহিলা এসে কিঞ্চিৎ কুণ্ঠা নিয়েই জানিয়েছিলেন, দ্বিতীয় পক্ষের বিয়েতে একটু বেশি বয়সেই জন্মেছিল ওই শিশু কন্যা।
কিন্তু প্রবল অস্বস্তি গ্রাস করায়, শেষতক তা ‘দত্তক’ হিসেবে তুলে দিয়েছিলেন অন্য এক মহিলার হাতে।
কিন্তু আইন কী অত সহজে সে কথা মানে? অতএব, সময় গড়িয়ে গিয়েছে, কিন্তু শান্তিপুরের হাসপাতালের ঠিকানা ছেড়ে ঘরে ফেরা হয়নি মা-মেয়ের।
কেন? আইন বলছে, মা-মেয়ের ডিএনএ মিললে তবেই মেয়েকে ঘরে নিতে পারবেন ওই মহিলা। কিন্তু প্রায় ন’মাস পেরিয়ে গেলেও ডিএনএ’র রিপোর্ট এসে পৌঁছয়নি।
শান্তিপুর স্টেট জেনারাল হাসপাতালের সুপার জযন্ত বিশ্বাস বলেন, “ওঁদের যত্নের কোন খামতি নেই। কিন্তু সেটাতো শেষ কথা নয়। হাসপাতালের পরিবেশে দিনের পর দিন রেখে দেওয়াটা সত্যিই অমানবিক। কিন্তু কী করব, আইনের উর্ধ্বে তো যেতে পারি না।’’
ডিএনএ-র ফল মিলতে যে বছর ঘুরে যায়, তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে সে কথা জানেন, রানাঘাট জিআরপি থানায় আইসি দেব কুমার রায়। বলেন, “আমরা একাধিকবার গিয়ে তদ্বির করেছি কলকাতার সেন্ট্রাল ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে (সিএফএল)। কিন্তু একই জবাব পেয়েছি, সময় লাগবে।’’
জানা গিয়েছে, এক বছর তো বটেই অনেক সময়ে নমুনা পাঠানো হয় হায়দরাবাদের পরীক্ষাগারেও। যা আসতে আরও অন্তত তিন থেকে ছ’মাসের ধাক্কা।
পোলিও-র টিকা থেকে অন্নপ্রাসন— হাসপাতালের নার্স মাসি আর ডাক্তার কাকুদের বদ্যানতায় সবই হয়েছে সুনুর। কিন্তু নিজের বাড়ি?
উলুবেড়িয়ার সেই বাড়িতে পা পড়তে বোধহয় নতুন জন্মদিন গড়িয়ে যাবে তার!