নোটের গুঁতো

ভোগ রাঁধতে বল ভরসা প্রণামী বাক্স

শেষতক হাত পড়ে গেল প্রণামীর বাক্সে। ভদ্রলোক কাঁচুমাচু মুখে বলছেন, ‘‘কী করব ভাই, চাতাল জুড়ে ছডিয়ে থাকা মানুষগুলো দু’মুঠো খিচুড়ি ভোগের জন্য হা পিত্যেশ করে বসে থাকে, না দিয়ে পারি!’’

Advertisement

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় ও অনল আবেদিন

শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০১৬ ০১:৩৩
Share:

শেষতক হাত পড়ে গেল প্রণামীর বাক্সে।

Advertisement

ভদ্রলোক কাঁচুমাচু মুখে বলছেন, ‘‘কী করব ভাই, চাতাল জুড়ে ছডিয়ে থাকা মানুষগুলো দু’মুঠো খিচুড়ি ভোগের জন্য হা পিত্যেশ করে বসে থাকে, না দিয়ে পারি!’’

কিন্তু, বিশ-ত্রিশ জনের খিচুড়ি তো চাট্টিখানি কথা নয়, চাল-ডাল-তেল-নুনের সঙ্গে শীতের বেলায় একটা পাঁচ মিশেলি তরকারি রাঁধতে গেলেও তো খরচ নেহাত কম নয়।

Advertisement

কিন্তু, নোটের ধাক্কায় মঠের জমানো টাকায় তো নুন আনতে পান্তা ফুরানোর দশা। তা হলে?

বাধ্য হয়ে তাই প্রণামীর বাক্সেই বুক বেঁধেছেন ওঁরা। সেই টাকা ভেঙেই নমো নমো করে হচ্ছে ভোগ।

টান পড়ছে মন্দিরের নিত্য আয়ে-ও। অন্য দিকে বদল আনতে হচ্ছে মন্দির পরিচালনার নানা প্রথা প্রকরণে। কোথাও কাটছাট করা হচ্ছে ভোগের মেনুতে, কোথাও মুদির দোকানে খুলতে হয়েছে ধারের খাতা।

এক রকম বাধ্য হয়েই কোনও কোনও মন্দিরে রোজকারের খরচ সামাল দিতে চিরাচরিত রীতি ভেঙে হাত দিতে হয়েছে প্রণামী বাক্সে। কেউ কেউ আবার মন্দিরের কর্মীদের মাস পয়লার বেতন (বাংলা মাসের হিসেবে) দিয়ে গিয়ে নাজেহাল।

নবদ্বীপের মহাপ্রভু মন্দিরের দৈনিক খরচের সিংহভাগ আসে ভক্তদের প্রণামী ও দান থেকে। নোট বাতিলের পর থেকে ভক্তদের আনাগোনা কমেছে চোখে পড়ার মতো। সেই সঙ্গে কমেছে দানের অঙ্ক। মন্দির কর্তৃপক্ষের কথায়, “এ বার রাসে যা লোক হয়েছে, যে কোনও রবিবার বা ছুটির দিনে ওর থেকে বেশি মানুষ আসেন। আর এখন তো দিনে একশো লোকও হচ্ছে না।” অথচ ভক্তদের প্রণামী ও দানের অর্থ দিয়েই ধামেশ্বর মন্দিরের বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী পূজিত মহাপ্রভুর নিত্য ভোগের ব্যয় নির্বাহ করা চিরাচরিত প্রথা। কিন্তু ভক্তদের যাতায়াত কমে যাওয়ায় টান পড়ছে সেখানে। রোজকার সংগৃহীত টাকার পরিমাণ কমে অর্ধেক হয়েছে। অন্যদিকে বাজার বা মুদিখানার দোকানে বেড়েছে ধারের পরিমাণ।

মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জ স্টেশনপাড়া কদমপুর রাধাগোবিন্দ মন্দিরের সেবাইত রায় রামানন্দ দাস তাঁর ষাটোর্ধ্ব জীবনে এমন ‘অনাছিষ্টি’ দেখেননি কখনও। প্রণামীর বাক্স থেকে তাঁর আরাধ্য দেবদেবীর আয় আগে ছিল দৈনিক শ’খানেক টাকা। তাঁর কথায়, ‘‘দিন দশেক থেকে সেই প্রণামী নেমে এসেছে ১৫-২০ টাকায়। অবিশ্বাস্য ব্যাপার! আগে দিনে দু’বার ভোগ ছিল। এখন নামিয়ে আনতে হয়েছে এক বারের অন্নভোগে।’’ সেই অন্নভোগের মেনুতেও আবার কাটছাট করতে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘আগে থাকত পাঁচ রকম ভাজা, ডাল, শুক্তো, দু’রকমের তরকারি, শুক্তো, ছানার পলি। সেখানে এখন পাঁচের বদলে একটি মাত্র ভাজা। দু’রকম তরকারির বদলে একটি তরকারিই রাঁধা হচ্ছে। ছানার পলি বাদ।’’ জিয়াগঞ্জের ঐতিহাসিক বড় গোবিন্দ বাড়ির সেবাইত মল্লিকা গোস্বামী বলেন, ‘‘আগে প্রণামী যা পড়ত, ক’দিন থেকে পড়ছে তার সিকিভাগ। ভক্তদের দেখাই নেই। চার বারের বদলে ভোগ তাই নেমে গিয়েছে দু’বারে। বাধ্য হয়েই গোবিন্দভোগ চালের বদলে এখন সাধারণ চালের ভোগ রাঁধতে হচ্ছে।’’

‘জরুরী’ অবস্থায় একই পদক্ষেপ করতে বাধ্য হয়েছেন মহাপ্রভু মন্দির পরিচালন সমিতির সম্পাদক জয়ন্ত গোস্বামী। জানালেন, আগে যে পরিমাণ ভোগ নিবেদন করা হত, পরিবর্তিত অবস্থায় সেটা কমাতে হয়েছে। সাধারণ সময়ে মন্দিরে গড়ে পঞ্চাশ জন প্রসাদগ্রহণ করতেন। এখন সংখ্যাটা অর্ধেক করা হয়েছে।

প্রাচীন মায়াপুরের চৈতন্য জন্মস্থান আশ্রমের প্রধান অদ্বৈত দাস মহারাজ জানান, প্রণামী বা দানবাবদ প্রতিদিন গড়ে আটশো থেকে হাজার টাকা পড়ত। আশ্রমের নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্র থেকে ছবি, বই, মালা, ঝোলা, তিলক বা অনান্য স্মারক বিক্রি করেও ভালই আয় হত। কিন্তু নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের পর থেকে ভক্তদের দান তলানিতে ঠেকেছে। মঠ প্রধানের কথায়, “আমাদের মন্দিরে যাঁরা টাকা দিয়ে দুপুরে বা রাতে প্রসাদ কেনেন কিংবা মঠের অতিথি আবাসে থাকেন, তাঁদের ভাঙানি ফেরত দিতে সমস্যা হচ্ছে। মঠের কর্মীদের রোজের মজুরি দিতে পারছি না। আমরা এখনও দূরদুরান্ত থেকে আসা ভক্তদের কাছ থেকে পুরনো নোট নিচ্ছি। কিন্তু আর কত দিন নিতে পারব, তা জনি না।”

নবদ্বীপ বলদেব জিউ মন্দিরের চিরকাল প্রনামী বাক্সে ভক্তদের দানের টাকায় বলদেব বিগ্রহের মূল্যবান পোশাক, চূড়া বা অনান্য জিনিস তৈরি করানো হত। কিন্তু নোট বাতিলের জেরে শতবর্ষের সেই প্রথা ভাঙতে বাধ্য হয়েছেন মন্দির কর্তৃপক্ষ। মন্দিরের তরফে কিশোরকৃষ্ণ গোস্বামী বলেন, “এখন ওই অর্থ দৈনন্দিন মন্দির খরচের কাজে ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছি।”

বহরমপুরের বিষ্ণুপুর কালীবাড়ির বয়স তিনশো বছরেরও বেশি। ঐতিহাসিক এই কালীমন্দিরে জেলা ও জেলার বাইরের ভক্ত সমাগমে মন্দির চত্বর সারা বছর গমগম করে। হেমন্তে ভক্তের ঢল নামে। মধ্য-হেমন্তে সেই মন্দির চত্বর এখন খাঁ খাঁ করছে। সেবাইত বিশ্বতোষ পাণ্ডে বলেন, ‘‘বাচোয়া একটাই, আমরা মাসের প্রথমেই মায়ের ভোগের উপকরণ কিনে রাখি। এই কারণে এখনও কাটছাট করতে হয়নি।’’

কিন্তু বহরমপুর শহরের পুরনো হাসপাতাল পাড়়ার জগন্নাথ দেবের ভোগে ভালই টান পড়েছে। বহরমপুর শহরের গোরাবাজার ফেরিঘাট লাগোয়া গ্রহরাজ মন্দিরের সেবাইত প্রফুল্ল ঠাকুর বলেন, ‘‘আমাদেরও একই দশা। দৈনিক ফলমিস্টির ভোগ দিচ্ছি। কোনও ভক্ত দয়া করে অন্নভোগ আনলে গ্রহরাজের মুখে তুলে দিই। নইলে ফলমূলই সই!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
আরও পড়ুন