কেবল কৈবল্যে নিষ্প্রাণ চা দোকানের আড্ডা

সেই হরিশপুরের চামটার বাঁকের মুখে রাস্তার ধারে চায়ের দোকানে ভর সন্ধ্যায় একটা টিমটিমে আলো জ্বলছে। বাইরের বেঞ্চে দু’জন লোক। বেঞ্চের তলায় ল্যাজ গুটিয়ে ঘুম দিচ্ছে লালু।

Advertisement

সুদীপ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১১ মার্চ ২০১৯ ০২:০০
Share:

টিভিতে পছন্দের চ্যানেল চলছে না। ফিকে হয়ে গিয়েছে খদ্দেরের ভিড়। নিজস্ব চিত্র

বিজেপি এ বঙ্গে রথ চালাতে পারবে কিনা তা নিয়ে জোর চর্চা চলেছিল চায়ের দোকানে। সে প্রায় কয়েক মাস আগের কথা। শীত তখনও তেমন পড়েনি। সন্ধ্যায় কাজ সেরে পাড়ার দোকানে এসে বসেছিলেন পাড়ার যুবা-বৃদ্ধরা। দোকানে এক কোণে বসানো টিভি। খবরের চ্যানেলে কথার যত ফুলকি ওঠে, চায়ের দোকানেও তর্কটা জমে ওঠে।

Advertisement

সেই হরিশপুরের চামটার বাঁকের মুখে রাস্তার ধারে চায়ের দোকানে ভর সন্ধ্যায় একটা টিমটিমে আলো জ্বলছে। বাইরের বেঞ্চে দু’জন লোক। বেঞ্চের তলায় ল্যাজ গুটিয়ে ঘুম দিচ্ছে লালু। টিভি আজও চলছে। কিন্তু সে দিকে কারও নজর নেই। চা বানিয়ে কূল পেতেন না যে পিয়ালী সাহা, সেই পিয়ালী শুকনো মুখে বসে। মাস কয়েকের মধ্যে আমূল বদলে গিয়েছে ছবিটা। পিয়ালী জানাচ্ছেন, কেব্‌ল টিভির খরচ বাড়ার পর দোকানের কেব্‌ল লাইন বন্ধ করে দিয়েছেন তিনি। তার পর থেকেই এই দৈন্য দশার শুরু। শুধু তার দোকান নয়, এখন বেশির ভাগ সময় দোকানই ফাঁকা পড়ে থাকে। চায়ের দোকানে রোজ দুধ দেন নবকুমার ঘোষ। তিনি বলেন, ‘‘আগে দিনে দশ, বারো লিটার করে দুধ বেচেছি। এখন পাঁচ-ছয় লিটারে এসে ঠেকেছে।’’

পিয়ালির দোকান ছাড়িয়ে কৃষ্ণনগরের দিকে একটু হাঁটলেই সুজয় সাহার চায়ের দোকান। চ্যানেলের খরচ বাড়ায় নিজের পছন্দের কয়েকটা চ্যানেল নিয়েছেন মাসে ২২০ টাকায়। সুজয় জানান, বন্ধ করে দেব ভেবেছিলেন। কিন্তু খদ্দের ধরে রাখতে দোকানে আবার কেবল লাইন নিতে হল। আগে মাসে ১৮০ টাকায় সব চ্যানেল আসত। এখন ২২০ টাকা দিয়ে মাত্র কয়েকটা। খরিদ্দার এসে পছন্দের চ্যানেল দেখতে পাচ্ছেন না। তাই দোকানে বসছেও না বেশিক্ষণ। তিনি বলেন, ‘‘এই দু’মাসে লোক অনেক কমে গিয়েছে দোকানে।’’

Advertisement

নবদ্বীপ যাওয়ার রাস্তার ধারে জাহাঙ্গিরপুরে গোপাল ঘোষের হোটেল ও চায়ের দোকানের। সারা দিনের কাজের শেষে সন্ধ্যায় গল্প করতে আসা ছেলে-বুড়োরা সিরিয়াল আর গানের অনুষ্ঠান পছন্দ করতেন। কিন্তু খেলাপাগল গোপাল কয়েকটা খেলার চ্যানেল রেখেছেন। ফলে, ওই ছেলেবুড়োদের আর ওই দোকানে দেখা যাচ্ছে না। দোকানের এক খদ্দের বিজয় হাজরা বলেন, ‘‘মাস দুয়েক হল আসা কমিয়ে দিয়েছি। কার সঙ্গে বসে দেশের-দশের গল্প করব? পছন্দের চ্যানেলগুলোই তো নেই এখানে।’’

ধুবুলিয়ার সোনডাঙার মন্টু শেখ কেবলের খরচ বাড়ায় চায়ের দোকানের টিভি ক’দিন বন্ধ রেখেছিলেন। কিন্তু লোকজন কমে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে কয়েকটা পছন্দের চ্যানেল নিয়ে কেবল কানেকশন নিতে হয়েছে তাঁকে। ‘‘চায়ের দোকান চালিয়ে কি এত টাকা দিয়ে লাইন নেওয়া সম্ভব?’’ মন খারাপ করে বলেন মন্টু। মন্টুর দোকানে আড্ডা দিতে আসেন ব্যাঙ্ককর্মী মুজিবর রহমান শেখ।

মুজিবর বলেন, ‘‘সন্ধেবেলা ঢুকতাম দোকানে। এর ওর সঙ্গে গল্প করে যখন বাড়ি ফিরতাম তখন গভীর রাত। আর এখন তো কিছুদিন কথা বলার লোকই আসে না। সাড়ে ন’টার মধ্যে বাড়ি ঢুকে যাই।’’ চায়ের দোকানে এমন দশা দেখে রসিকতা করচে ছাড়ছেন না কে‌উ কেউ। তাঁদের কথায়, ‘‘যে দেশের প্রধানমন্ত্রী চা বেচতেন, তাঁর দেশের চা-ওয়ালাদের এমন দশা কেন?’’ আবার কেউ বলছেন, ‘‘তেলেভাজা যে রাজ্যের শিল্প, চা-ওয়ালাদের জন্য কেনই বা ভাবনা নেই?’’

এত কিছু বোঝেন না চা বিক্রেতারা। তাঁরা চান, টিভি দেখার খরচটা কমুক। খদ্দের আসুক আগের মতো। প্রাণ ফিরে পাক হারিয়ে যেতে বসা আড্ডাটা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন