ঘরে ফেরা। — ফাইল চিত্র
কখনও কেমনে এক-আধটা লেফাফা। সপ্তাহান্তে এক-আধবার ফোন। ব্যাস!
তাঁদের ঘর-উঠোন-পুকুর পড়ে থাকে। ছোট্ট মেয়েটার ক্লাস বদলে যায়। ঘরে ফেরা হয় না!
পরবাসী মানুষের অপেক্ষার সেই দিনরাত মিলিয়ে দেয় ইদের চাঁদ। সম্বচ্ছরে এই সময়টাতেই তো ঘরে ফেরে বিদেশ-বিভুঁইয়ে থাকা রোজগেরে ছেলেরা। রমজানের সেই পয়লা দিন থেকেই তাই পথ চাওয়া শুরু হয় নদিয়া-মুর্শিদাবাদের সীমান্ত ঘেঁষা গ্রামগুলিতে। কেউ আরব থেকে ফেরেন ইদের দিন দশেক আগে। কেউ কেরল থেকে ফেরেন সপ্তাহখানেক আগে। সঙ্গে লোটাকম্বল, বাড়ির জন্য জমানো টাকা আর উপহার।
দুয়ারে কড়া নাড়ার আওয়াজ শুনে বৃদ্ধা মা ঠিক বুঝতে পারেন, ‘‘আসমত এসেছে গো। দোর খোল।’’ বহরমপুর স্টেশনে নেমে হিজলের বাড়িতে স্ত্রীকে ফোন করেন সোলেমান, ‘‘নেমে পড়েছি। এই এলুম বলে।’’ তারপর পরব ও স্বজনের বাড়ি ফেরার জোড়া আনন্দে মেতে ওঠে আটপৌঢ়ে গ্রামগুলো।
জল-জঙ্গলে ঘেরা কান্দির দুর্গম এলাকটির নাম হিজল। হিজল আসলে সুন্দরবনের বাদাবনের মতো হিজলের জঙ্গল। কিন্তু পেট যে বড় বালাই। তাই সেই সবুজ জল-জঙ্গলের জনপদ ছেড়ে জীবিকার টানে হিজল এলাকার কয়েক হাজার মানুষকে বছরভর পড়ে থাকতে হয় আরব মুলুকের মরুপ্রান্তরে। কারও জীবিকা দুম্বার পাল নিয়ে চারণ ভূমিতে মাসের পর মাস পড়ে থাকা। কেউ করেন ঝাড়ুদারের কাজ। কারও ঠিকানা আবার হোটেল কিংবা নির্মাণ সংস্থার মরুপ্রান্তর।
সংসারে শ্রী ফিরবে। সন্তান দুধেভাতে থাকবে। চিকিৎসা করাতে হবে বৃদ্ধা মায়ের। সেই আশাতেই তাঁদের এই কৃচ্ছসাধন। বছরভর মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার। রোজার ইদের দিন দু’য়েক আগে আরব থেকে হিজলের বাড়িতে ফিরেছেন জিল্লার শেখ। ফের সৌদির দিকে তিনি পা বাড়াবেন মাস খানেক পরে। এই সারা মাস তিনি সপরিবার তিনি হইহই করে কাটাতে চান। বিভিন্ন এলাকায়
বসত করা আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে যেতে চান।
জিল্লার বলছেন, ‘‘ইদের সুবাদে এই একটা মাস আমাদের আনন্দ, অবসর যাপন। তারপর তো ফের সেই মরু-দেশে।’’
চাপড়ার ওলামিন শেখ কর্মসূত্রে থাকেন কেরলে। সারা বছরে বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ বলতে চিঠি আর ফোন। বাড়ি ফেরার জন্য তিনি প্রতি বছর বেছে নেন ইদের সময়টাতেই। ওলামিন বলছেন, ‘‘দিন কুড়ি বাড়িতে থাকব। সপরিবার ঘুরে বেড়াব আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি। তেমন হলে একবার কলকাতাতেও ঘুরতে যাব। মেয়েটা সেই কবে থেকে বলছে পাতালরেলে চড়বে।’’ ছত্তীসগঢ়ের রায়পুরে কাপড়ের ব্যবসা করেন লক্ষ্মীগাছার জহিরউদ্দিন ধাবক। তিনিও ফিরেছেন ইদের দিনকয়েক আগে। জহির বলছেন, ‘‘কী বলছেন! এই সময়টার জন্যই তো সারাটা বছর এত কষ্ট করতে পারি। এখন ক’দিন দেশের বাড়িতে সকলের সঙ্গে কাটিয়ে বুক ভরে অক্সিজেন নেব। তারপর ফের সেই ভিন রাজ্যে পাড়ি দেওয়া।’’
সম্প্রতি লালগোলার মকিমনগর, সিমুলিয়া ও হাটপাড়ার মতো গ্রামে ইদ ঘিরে অন্য এক বিষয় চোখে পড়ছে। চট-জলদি বিয়ে। শিমুলিয়ার আসাদুল হক বলেন, ‘‘সুরাট, চেন্নাই, কেরল- সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা রাজমিস্ত্রিরা লালগোলার বাড়িতে ফিরে সব থেকে বেশি দিন কাটাতে পারে ইদের সময়। তাই ইদের পরের সপ্তাহ খানেকের মধ্যে এই তল্লাটের এক একটি গ্রামে ১২-১৪টি করে বিয়ে হয়। কয়েক বছর থেকে এই চলটা খুব চলছে।’’
লালগোলার মল্লিকপুরের সারাফৎ শেখ বছর চারেক থেকে চেন্নাইয়ে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। হাটপাড়ার সেন্টু খান আবার ওড়িশায় থাকেন। তিনিও রাজমিস্ত্রী। তাঁদের কথায়, ‘‘বিদেশে থাকি পেটের তাগিদে। কিন্তু পরবের দিনে বাড়ি ফেরার মজাই আলাদা। ট্রেনে, বাসে এই সময় খুব ভিড় হয়। কিন্তু সে সব কষ্ট বাড়ি ফেরার আন্নদের কাছে ফিকে হয়ে যায়।’’
ইদের সকাল থেকেই ভোনা সেমুই, লাচ্চা সেমুই, বিরায়ানি, পোলাও, কাবাব, লুচি ও আতরের গন্ধে ম ম করছে সারা জেলা। মুরুটিয়ার আসমিনা বিবি বলছেন, ‘‘ভালও লাগছে। আবার সেই সঙ্গে মনখারাপও করছে। আসলে এই তো ক’টা দিন। দেখতে দেখতেই কেটে যায়। তারপরেই তো ও চলে যাবে।’’
তারপর আবার ঘর তাঁদের অপেক্ষায় থাকবে। অপেক্ষায় থাকবেন ঘরনি। অপেক্ষায় থাকবে তামাম গ্রাম।