এ বারের ইদেও কি পাকশি সীমান্তে এমন দৃশ্যের দেখা মিলবে?—ফাইল চিত্র।
রংমহল থেকে ফোনটা এসেছিল ইফতারের ঠিক পরেই।
—‘ও আপা, এ বার ইদে কি দেখা হবে না? তোমাদের বিএসএফ অনুমতি দেবে?
—‘কী জানি রে, বর্ডারে খুব কড়াকড়ি চলছে। গুলশনে যা হল!’
—‘তবে?’
দু’দেশের দু’প্রান্তে ক্ষণিকের স্তব্ধতা। গলাটা ধরে আসে দুই বোনের। ফোন রাখতেই আষাঢ়ের সন্ধ্যায় ঝেঁপে বৃষ্টি নামে ।
সম্বচ্ছরে এই একটা মাত্র দিন। ইদ-উল-ফিতর। চাতকের মতো এই দিনটার অপেক্ষায় থাকেন দুই বাংলার মানুষ। বিএসএফের অনুমতি নিয়ে কাঁটাতারের দু’পারে জড়ো হন দুই দেশের বাসিন্দারা। বৃদ্ধ বাবা মেয়েকে দেখেন কত দিন পরে। বিদেশে থাকা ভাইয়ের সঙ্গে ও পার বাংলার দিদির দেখা হয় বছর কুড়ি পর। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পরে এ পারের প্রৌঢ়া চিনতে পারেন তারকাঁটার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা সেই কতদিন আগে ফেলে আসা পড়শিকে।
ইদে খুশির বাঁধ ভাঙে সীমান্তে। বিএসএফের ভারী বুটের আওয়াজ, সীমান্তের রাঙাচোখ উপেক্ষা করে কয়েক ঘণ্টার জন্য হলেও যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় দুই বাংলা। পরবের দিনে এ এক বিরাট প্রাপ্তি! কিন্তু এ বার ইদে সেই মিলনমেলায় বাধ সাধল বাংলাদেশের গুলশনের সেই রেস্তোরাঁ।
‘‘এটা কোনও কাজের কথা হল কর্তা? পবিত্র রমজানে এত রক্ত, এত নৃশংসতা! জঙ্গিরা জঙ্গিই। ওদের কোনও ধর্ম হয় না। কখনও জঙ্গি, কখনও পাচারকারী, কখনও দুষ্কৃতীদের জন্যই ফল ভুগতে হয় আমাদের মতো দু’দেশের সাধারণ মানুষকে। ভাবতেই পারছি না, এ বারের ইদে ওপারের আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা হবে না!’’ কথা বলতে বলতে হাঁফাচ্ছেন পাকশির বছর সত্তরের ইয়াকুব মল্লিক।
কাঁটাতারের ওপারে খাসমহল, রংমহল, তেঁতুলবেড়িয়া, গাংনি। জেলা মেহেরপুর। এ পারে ব্রজনাথপুর, পাকশি, বেড় রামচন্দ্রপুর, পিপুলবাড়িয়া। জেলা নদিয়া। আত্মীয়-স্বজন রয়েছে দু’পারেই। আগে যখন সীমান্তে এত কড়াকড়ি ছিল না তখন বিয়ে-শাদি হয়েছে দু’দেশের লোকজনের মধ্যেই। বিএসএফকে বলে এ-পার, ও-পার যাতায়াতও এমন কিছু কঠিন ব্যাপার ছিল না।
তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সীমান্ত কঠোর হয়ে গিয়েছে। ভিসা-পাসপোর্ট করে নিয়ম মেনে দু’দেশে যাতায়াত সকলের পক্ষে সম্ভব নয়। ভরসা বলতে আগে ছিল চিঠি। এখন ফোন। তাতেও বড় বেশি খরচা। আর শুধু কথা বলে কি আশ মেটে! পিপুলবাড়িয়ার রিমা বিবি যেমন বলছেন, ‘‘সেই কবে থেকে দিন গুনছি, এ বার ইদে ছোট ভাইটাকে একবার চোখের দেখা দেখতে পাব। জানেন, সেমুই খেতে ছেলেটা বড্ড ভালবাসে। ভেবেছিলাম, ওর জন্য কৌটো করে একটু সেমুই নিয়ে যাব। কিন্তু এ বার বর্ডারের যা অবস্থা, সে কি আর হবে?’’
আশা-নিরাশার দোলাচলে যখন দুলছে নদিয়ার সীমান্ত তখন মুর্শিদাবাদের জলঙ্গির ইমরান আলি বলছেন, ‘‘রাখ তো বাপু তোমাদের সীমান্তের আইন-কানুন। কালে কালে আর কত দেখব! বছর কয়েক আগেও বিএসএফকে বলে ইদের দুপুরে কুষ্টিয়ার ওপার বাংলায় গিয়ে পাত পেড়ে খেয়ে আসতাম বিরিয়ানি আর খাসির মাংস। কোনও বার ওপার বাংলা থেকেও ইয়ার-দোস্তরা চলে আসত এপারে। তারপর সন্ধ্যা নামার আগে যে যার ঘরে ফিরতাম।’’
শুধু জলঙ্গি নয়, পুজো-পরবে কিংবা অন্য কোনও অনুষ্ঠানে রানিনগর, লালগোলা, নির্মলচরের মতো এলাকার বাসিন্দাদের যাতায়াত ছিল ওপারে। স্থানীয় বাসিন্দাদের আক্ষেপ, ‘‘এখন অবশ্য সে সব অতীত। পরবের খুশি আটকে গিয়েছে সীমান্তের বেড়াজালে।’’ সুতির রমাকান্তপুর কিংবা বাজিতপুরের মেলায় দেখা মিলত ওপার বাংলার বহু মানুষের। কিন্তু গত কয়েক বছর থেকে তা-ও বন্ধ।
পিপুলবেড়িয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য তৃণমূলের আদের আলি মণ্ডল বলছেন, ‘‘বিএসএফের অনুমতি নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে ইদের দিনে এমন ব্যবস্থা করা হত। এ বারেও বিষয়টি জানিয়ে রেখেছি। তবে বাংলাদেশে যা পরিস্থিতি তাতে বুঝতে পারছি না
কী হবে।’’
বিএসএফের এক কর্তার কথায়, ‘‘সীমান্তের মানুষের এই আবেগকে আমরা সম্মান করি। সেইসঙ্গে নিরাপত্তাটাও একটা বড় বিষয়। এ বারে ইদের দিনে দুই বাংলার মানুষ দেখা করতে পারবেন কি না সেটা এখনও পর্যন্ত অনিশ্চিত।’’
গত বার কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁক দিয়ে বোনঝিকে মিষ্টির ঠোঙাটা দিতে গিয়ে হাত ছড়ে গিয়েছিল কারিমন বেওয়ার। ক্ষত মিলিয়ে গিয়েছে। কিন্তু কব্জির উপরে দাগটা এখনও থেকে গিয়েছে। সেই দাগটার উপরে হাত রেখে কারিমন বলছেন, ‘‘একটু রক্ত বেরিয়েছে বলে নাজমার সে কি আকুলিবিকুলি। ওড়নাটা ছিঁড়ে গলিয়ে দিল এপারে। এ বারেও আসবে বলেছিল। কিন্তু...।’’
ইদের চাঁদ উঠবে। খুশিতে মাতবে তামাম দেশ। কিন্তু ইদের দুপুরে কারিমন-নাজমার কি দেখা হবে? নাকি আরও একটা বছর অপেক্ষায় থাকবে বৃষ্টিভেজা কাঁটাতার?