মুকুল রায়ের ‘কাছের লোক’—এই তকমা দিয়ে এক ধাক্কায় রানাঘাট মহকুমার তিন ব্লক সভাপতিকে সরিয়ে দেওয়া হল। বিধানসভা ভোটের আগে দলের অন্দরে এ নিয়ে জোর চর্চা শুরু হয়েছে। কিছু দিনের মধ্যে আরও কিছু রদবদল হতে পারে বলে তৃণমূলেরই একটি সূত্রে খবর।
তা জেনে দলেরই একটি অংশ বলতে শুরু করেছে, দু’একজন জেলা নেতার মর্জিতে দল চলছে। তাঁরা নিজেদের স্বার্থে ইচ্ছে মতো সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। তাঁদের সঙ্গে বনিবনা না হলেই মুকুল রায়ের কাছের লোক-সহ নানা অজুহাতে তাঁদের সরিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে ‘নিজেদের লোক’ বসিয়ে দিচ্ছেন। নানা গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বে দীর্ন নদিয়ায় এই রদবদলে দলের কোন্দল আরও বাড়বে বলেই তাঁদের আশঙ্কা। যদিও এ ব্যাপারে কেউই প্রকাশ্যে কিছু বলতে চাননি। জেলা তৃণমূল সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্ত রদবদল প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘সামনে বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে দলকে আরও গতিশীল করতেই ৩ ব্লক সভাপতিকে সরানো হয়েছে।’’
গত শুক্রবার বিদায়ী তিন ব্লক সভাপতির কাউকে চিঠি দিয়ে , কাউকে ডেকে পাঠিয়ে, আবার কাউকে কিছু না জানিয়েই পদ থেকে সরানো হয়েছে। সরলেন যাঁরা তাঁরা হলেন—রানাঘাট ১ ব্লক সভাপতি তাপস ঘোষ, রানাঘাট ২ ব্লক সভাপতি সমীর পোদ্দার এবং হাঁসখালির ব্লক সভাপতি কৃষ্ণকিঙ্কর ঘোষ ওরফে মন্টু। তাপসবাবুর জায়গায় প্রদীপ সরকারকে, সমীরবাবুর জায়গায় ফিরোজ আলি মণ্ডল এবং কিঙ্করবাবুর জায়গায় দুলাল বিশ্বাসকে ব্লক সভাপতি করা হয়েছে। প্রদীপবাবু এক সময় কিছু দিনের জন্যে ব্লক সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। ফিরোজ দলের বহিরগাছি অঞ্চল সভাপতি এবং দুলালবাবু বগুলা ১-এর পঞ্চায়েতের প্রধান।
বিদায়ী ব্লক সভাপতিরা এখনও নানা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন। তাপসবাবু বর্তমানে রানাঘাট ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি, সমীরবাবু রানাঘাট উত্তর পূর্ব কেন্দ্রের বিধায়ক, কৃষ্ণকিঙ্করবাবু হাঁসখালি পঞ্চায়েত সমিতির পূর্ত বিভাগের কর্মাধ্যক্ষ। ১৯৯১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রদেশ যুব কংগ্রেসের এবং উজ্জ্বল বিশ্বাস জেলা যুব কংগ্রেসের সভাপতি থাকার সময়ে রানাঘাট ১ ব্লকের যুব কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয় তাপস ঘোষকে। তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকেই তিনি দলের সঙ্গে যুক্ত। ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ১৮১ ভোটে কংগ্রেস প্রার্থী শঙ্কর সিংহকে হারিয়েছিলেন। অনেকের মত, তখন শঙ্করবাবু জিতলে জেলায় তৃণমূলের উত্থান এত দ্রুত হত কি না তা নিয়েই বিতর্ক থেকেই যায়!
এ বারের পুর-নির্বাচনে বীরনগর এবং তাহেরপুর পুরসভার দায়িত্ব তাঁর বদলে রানাঘাট উত্তর পশ্চিমের বিধায়ক পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায় এবং জেলা যুব কংগ্রেসের সভাপতি তথা কৃষ্ণগঞ্জের বিধায়ক সত্যরঞ্জন বিশ্বাসের উপরে দেওয়া হয়। ওই দুই পুরসভায় ফল আশানুরূপ না হওয়ার তার দায় বর্তেছে তাপসবাবুর উপরে! এক অনুগামীর কথায়, ‘‘দাদাকে ওই দুই পুরসভার দায়িত্ব দেওয়া হল না। আবার ফল যখন খারাপ হল তখন দায় দাদার ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেন জেলা নেতারা!’’
রানাঘাট দক্ষিণের বিধায়ক আবীররঞ্জন বিশ্বাস এবং রানাঘাট পশ্চিমের বিধায়ক তথা পুরপ্রধান পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাপসবাবুর তেমন বনিবনা নেই বলে একটি সূত্রে খবর। বিধানসভা ভোটের আগে সে কথা মাথায় রেখে তাঁকে সরানো হল বলে মনে করছেন অনেকে। তৃণমূলের অন্দরের খবর, জেলা সভাপতি গৌরী দত্তের সঙ্গেও সখ্যতা নেই তাপসবাবুর। ফলে সবটাই তাঁর বিপক্ষে গিয়েছে।
তাপসবাবুর মতোই তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকে দল করছেন সমীরবাবু এবং কৃষ্ণকিঙ্করবাবু। সমীরবাবুর দক্ষতাতেই বাম আমল থেকেই তাঁর এলাকায় তৃণমূল ভাল ফল করতে শুরু করে। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে রেলের চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি ভোট দাঁড়িয়েছিলেন। স্ত্রী মিতা পোদ্দার রানাঘাট ২ পঞ্চায়েত সমিতির দীর্ঘ দিনের সদস্যা। গতবার তিনি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি হন। সেটাই সমীরবাবুর বিপক্ষে গিয়েছে বলে দলের এক সূত্রে খবর। জেলার এক নেতা তাঁকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলেছেন, ‘আপনি বিধায়ক। স্ত্রী পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি। তাই ব্লক সভাপতি পদ থেকে আপনাকে সরতে হবে!’ আর, কৃষ্ণকিঙ্করবাবু অন্যের মুখে জেনেছেন তিনি আর হাঁসখালির ব্লক সভাপতি পদে নেই!
বিদায়ী ব্লক সভাপতিরা যে দক্ষ সংগঠক—সে তথ্য অস্বীকার করছেন না কেউ। বিভিন্ন সময়ে তাঁরাই ছিলেন ভোট-সেনাপতি। একাধিক ভোটে সাফল্যও এনে দিয়েছেন। রদবদলের পরে এঁদের কেউ এখনই দলের বিরুদ্ধে যাচ্ছেন না। তাপস ঘোষ বলেন, ‘‘দল কোন পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে, সেটা বড় কথা নয়। যতদিন রাজনীতি করব, দলনেত্রীকে দেখে করব।’’ সমীরবাবু বলেন, ‘‘দল যা ভাল ভেবেছে সেটাই করেছে।’’ হাঁসখালির বিদায়ী সভাপতি কৃষ্ণকিঙ্কর ঘোষ অবশ্য বলেন, ‘‘এ ভাবে না সরিয়ে পদত্যাগ করার সুযোগ করে দিলেই ভাল হত!’’