দুর্ঘটনার পরে মরণাপন্ন ছেলে এক ফোঁটা জল চেয়ে পায়নি

বিমার টাকায় নলকূপ গড়ছেন বাবা

তেহট্টের ফতাইপুরে বাড়ির দাওয়ায় বসে তেসের বলছেন, ‘‘ছেলেটাই তো চলে গেল। ওই টাকা নিয়ে আমরা কী করব? শুনেছি, ছেলেটা অ্যাম্বুল্যান্সে যাওয়ার সময় খুব পানি খেতে চেয়েছিল। সে তো আর পারলাম না। এই টাকায় অন্তত গাঁয়ে পানির কষ্টটা মিটুক।’’ তেহট্টের মহকুমাশাসক সুধীর কোন্তম বলেন, ‘‘তেহেরের এমন উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়।’’

Advertisement

কল্লোল প্রামাণিক

শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০১৭ ১৩:০০
Share:

ভরসা: সেই নলকূপ। নিজস্ব চিত্র

কুয়াশা ফুঁড়ে ছুটে চলেছে একটা অ্যাম্বুল্যান্স। নাগাড়ে ঘুরে চলেছে নীল আলোটা। রক্তে ভেসে যাচ্ছে একমাত্র সন্তানের দেহ। বিড়বিড় করে সে বলছে, ‘‘ও আব্বা, একটু পানি দাও গো!’’

Advertisement

এই দুঃস্বপ্নটা মাঝেমধ্যেই ঘুম ভাঙিয়ে দেয় তেসের আলির। অ্যাম্বুল্যান্সের বুককাঁপানো আওয়াজটা তখনও কানে বাজে তাঁর। ‘‘যাওয়ার আগে ছেলেটাকে একটু পানি দিতেও পারলাম না!’’ ভিজে যায় তেসেরের দু’চোখ।

গত মাসে তেসের হাতে পেয়েছেন দু’লক্ষ পাঁচ হাজার টাকা। একমাত্র সন্তানের দুর্ঘটনাজনিত বিমার টাকা। কিন্তু সেই টাকা দিয়ে কী হবে?

Advertisement

তেসের ও তাঁর স্ত্রী ফারসিয়া বিবি সিদ্ধান্ত নেন, ওই টাকা দিয়ে তাঁরা গ্রামের জলকষ্ট দূর করবেন। ইতিমধ্যে তাঁরা সাতটি নলকূপ বসিয়েছেন। আরও কয়েকটি বসানো হবে। বেশ কিছু টাকা তাঁরা রেখে দিচ্ছেন, বিকল হয়ে পড়লে ওই নলকূপগুলো মেরামতির জন্য।

তেহট্টের ফতাইপুরে বাড়ির দাওয়ায় বসে তেসের বলছেন, ‘‘ছেলেটাই তো চলে গেল। ওই টাকা নিয়ে আমরা কী করব? শুনেছি, ছেলেটা অ্যাম্বুল্যান্সে যাওয়ার সময় খুব পানি খেতে চেয়েছিল। সে তো আর পারলাম না। এই টাকায় অন্তত গাঁয়ে পানির কষ্টটা মিটুক।’’ তেহট্টের মহকুমাশাসক সুধীর কোন্তম বলেন, ‘‘তেহেরের এমন উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়।’’

গ্রামের নিয়াকত মণ্ডল, লতিফা বিবি, আলেয়া বিবিরা সমস্বরে বলছেন, ‘‘আমাদের গাঁয়েও খুব পানির আকাল। গরমে সে কষ্ট আরও বেড়ে যায়। তেসের যে কত বড় উপকার করল তা বলে বোঝানো যাবে না।’’ সেই সঙ্গে গ্রামবাসীদের আক্ষেপ, তবে ছেলেটা মরে যাওয়ার পর থেকে লোকটাও কেমন চুপ মেরে গেল!

ফতাইপুরের বহু পুরনো বাসিন্দা তেহের। নিজের সামান্য কিছু জমিজিরেত আছে। চাষআবাদ করেই স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে দিব্যি গড়াচ্ছিল সংসারের চাকা। ভাল পাত্র দেখে দুই মেয়ের বিয়েও দিয়েছেন তিনি। অঘটনটা ঘটল ২০১৫ সালের ৬ জানুয়ারি।

একমাত্র ছেলে আবদুল আহমেদের সে বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। প্রস্তুতও হচ্ছিল পুরোদমে। লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলোতেও আবদুল যথেষ্ট ভাল ছিল। স্থানীয় প্রশাসন ৬ জানুয়ারি শ্যামনগর থেকে তেহট্ট পর্যন্ত ম্যারাথন দৌড়ের আয়োজন করেছিল। সে দিন সকালে বাড়ি থেকে সাইকেলে বেরিয়েছিল আবদুল। কিন্তু দৌড় শুরুর আগেই সে হেরে যায়। রাস্তাতে ট্রাকের ধাক্কায় গুরুতর জখম হয়। প্রায় ৪৫ মিনিট পরে অ্যাম্বুল্যান্স আসে। সেখান থেকে তেহট্ট মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। খবর পেয়ে হাসপাতালে ছোটেন তেসের ও ফারসিয়া। কিন্ত ততক্ষণে সব শেষ।

নতুন নলকূপ পেয়ে উচ্ছ্বসিত গাঁয়ের লোকজন। কচিকাঁচারা জল ছিটিয়ে হইচই করছে। দূরে দাঁড়িয়ে তেসের বিড়বিড় করেন, ‘‘শুধু তোর মুখেই একটু পানি তুলে দিতে পারলাম না বাপ!’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement