অলঙ্করণ: সুমন চৌধুরী।
বর্ষার ভরা মজলিস। এক তরুণী গান ধরতেই শ্রোতাদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। সরস্বতী যেন তাঁর উপরে একটু বাড়াবাড়ি রকমের নির্দয় ছিলেন। বেসুরো, রুখু গলার গান আর কাঁহাতক সহ্য করা যায়! কিন্তু আসর ছেড়ে নড়ার জো নেই। বাইরে তখন ঝেঁপে বৃষ্টি। এ দিকে, সামনে এত শ্রোতা দেখে শিল্পী উৎসাহে গলা আরও চড়ালেন।
এক বৃদ্ধ আর বসে থাকতে পারলেন না। হাতের ঢাউস ছাতাখানা লাঠির মতো বাগিয়ে সোজা এগিয়ে গেলেন মঞ্চের দিকে। তাঁকে দেখেই তড়িঘড়ি গান থামিয়ে দিলেন শিল্পী। মঞ্চের চারপাশে তখন পিন পড়ার স্তব্ধতা। এই বুঝি কিছু একটা ঘটে গেল। বৃদ্ধ হাতের ছাতাটা সজোরে মাটিতে হুঙ্কার দিলেন, “তুমি গেয়ে যাও মা। কোনও ভয় নেই। আমি শুধু খুঁজছি তাঁকে যিনি তোমাকে নিয়ে এসেছেন!’’
এই গল্প অন্য ভাবেও শোনা যায়। তবে বর্ষাসাথীর এমন সরস মেজাজ সচরাচর দেখা যায় না। যদিও ছাতাকে বৃষ্টি-বাদলের সমার্থক ভাবনা একেবারেই হাল আমলের। এ দেশেও বছর চল্লিশ আগে ছাতার কদরই ছিল আলাদা। বিত্তবানদের ঘরে থাকত আধমানুষ উঁচু ছাতা। লোহার শিক আর পেল্লাই সাইজের বেতের ডাণ্ডাওয়ালা সে ছাতা যাঁর ঘরে থাকত আভিজাত্যের গর্বে তাঁর পা যেন মাটিতে পড়তই না সে কালে। পড়বেই পা কেন?
তখন তো বেশির ভাগ মানুষের হাট-বাজার থেকে মাঠেঘাটে কাজে যাওয়ার জন্য মাথার উপরে বসানো থাকত বাঁশের চাটাই কিংবা শালপাতা দিয়ে তৈরি মাথাল কিংবা টোকা। কাঠফাটা রোদ্দুরে কিংবা ভরা বর্ষায় টোকা মাথায় জমিতে কাজ করতেন মজুরেরা। গর্বিত জমিমালিক ছত্রপতি হয়ে বসে থাকতেন মাঠের আলে। অনেক সময় সেই ছাতা ‘দেওরা’ না হলেও কেউ না কেউ ধরে থাকতেন।
এখন অবশ্য দিন বদলেছে। ছত্রধর বললে লোকে অন্য মানে খোঁজে। ছাতাও এসেছে হরেক কিসিমের। কিছু ছাতা আড়ে-বহরে এতই ছোট যে দিব্যি পকেটে ঢুকে যেতে পারে। এখন তো মোটরবাইকের মাথাতেও ছাতার আমদানি হয়েছে। নতুন প্রজন্মকে টানতে শহরের কিছু মল কিংবা বড় দোকানে ফিরে এসেছে সেকেলে ‘দাদুর ছাতা’। জিয়াগঞ্জের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সমীর ঘোষের এখনও মনে আছে, “কুটুমের হাতে বড়বাঁটওয়ালা ছাতা না থাকলে আত্মীয়ের বাড়িতে জাত যেত!”
অনেকের ছাতা, টোকাও জুটত না। বর্ষার দিনে তাঁদের সম্বল ছিল পেল্লাই সাইজের কচুপাতা। ভগবানগোলার বৃদ্ধ আলিম আলি বলছেন, “ছাতা কেনার টাকা কোথায়! কচুপাতাতেই বর্ষা কাবার হয়ে যেত। কেউ কেউ আবার সারের বস্তাকেও কায়দা করে ব্যবহার করতেন। বৃষ্টি থেকে মাথা-পিঠ বেঁচে যেত।’’
তবে ছাতার সুদিন এখনও ধরে রেখেছে নবদ্বীপের মঠমন্দির। বাহারি হাতল, চার ফুটেরও বেশি লম্বা ভারী দণ্ড থেকে কাপড় লাগানোর শিক সবটাই খাঁটি রূপো দিয়ে তৈরি। সন্ন্যাস গ্রহণের পরে বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী আর কখনও সাক্ষাৎ পাননি চৈতন্যদেবের। ছেড়ে যাওয়া পাদুকাজোড়াই ছিল চৈতন্যপত্নীর বাকি জীবনের একমাত্র সম্বল। সেই ‘চরণ-পাদুকা’ ঢাকা রয়েছে নিরেট রূপোর ছাতা।
আর ছাতা হারানো? গল্পে, কবিতায় তা নিয়ে কত কথা। অমুক পাল, তমুক দত্তের ছাতা হারিয়ে বাড়ি ফিরে বকুনি খেতে হয়নি এমন বাঙালি খুব কমই আছে। বাড়ি ঢুকেই শুনতে হয়, ‘‘সামান্য একটা ছাতা পর্যন্ত সামলাতে পার না!’’ সে শোকে যেন মেঘেরও বুক ফেটে যায়। আজও হা পিত্যেশ করে বসে আছে সুকুমার রায়ের ‘ছাতার মালিক’ গল্পে সেই দেড় বিঘৎ মানুষেরা। ঠাকুমার মুখে তারা শুধু শুনেছে, যখন ভরা বাদল নামে, বনবাদাড়ে লোক থাকে না, ব্যাঙ আপন ছাতার তলায় বসে মেঘের সঙ্গে তর্ক করে। তান জুড়ে দেয়। কিন্তু ব্যাঙ কবে আসবে?
গ্রামের বুড়ি ঠাকুমা আজও বলেন, “ছাতা যখন আছে, একদিন না একদিন ব্যাঙ ফিরে আসবেই। আর বলবে, ‘আমার ছাতা কই’?”