হরবোলা ডাকটা জড়িয়ে গিয়েছে সুতোকাটা ঘুড়িতে

হবহু এক! এতটাই যে, পাখিগুলো পর্যন্ত চমকে উঠত। বাড়ির পুরনো নিমগাছ থেকে ভেসে এল— কু... হু ... উত্তর দিল দোতলার বারান্দা— কু... হু... এক বার, দু’বার, তিন বার।

Advertisement

সুপ্রকাশ মণ্ডল ও কৌশিক সাহা

কল্যাণী ও কান্দি শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০১৬ ০২:২১
Share:

হবহু এক!

Advertisement

এতটাই যে, পাখিগুলো পর্যন্ত চমকে উঠত।

বাড়ির পুরনো নিমগাছ থেকে ভেসে এল— কু... হু ...

Advertisement

উত্তর দিল দোতলার বারান্দা— কু... হু...

এক বার, দু’বার, তিন বার।

বেচারা কোকিল! হতভম্ব হয়ে এক্কেবারে চুপ। তারপর ডানা ঝাপটে লম্বা উড়ান।

ছেলের কাণ্ড দেখে হেসে খুন হতেন আহ্লাদী। বলতেন, ‘‘ওরে, তোর অত্যাচারে দেখছি বাড়িতে কাকপক্ষীও বসবে না।’’

বাবা নরেন্দ্রনাথ বুক ফুলিয়ে বলতেন, ‘‘ব্যাটা আমার হরবোলা। হ্যাঁ রে, কুকুরগুলো মারপিট করার সময় কী ভাবে ডাকে?’’

একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে হাতদুটো মুখের কাছে এনে শুরু হত—ঘেউ, ঘেউ, ভৌ, ভৌ...

তড়িঘড়ি হেঁশেল ফেলে খুন্তি হাতে ছুটে আসতেন বাড়ির কর্ত্রী। কিন্তু কোথায় কুকুর?

আহ্লাদীর চোখমুখ দেখে বাবা-ছেলে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ত।

খড়গ্রামের হরিনারায়ণপুরের নদী পাড়ের একচিলতে ওই বাড়িতে আর কেউ হাসেন না।

উঠোনের গাছে বসে একাই ডেকে যায় কাক, কোকিল, টিয়া।

দোতলার বারান্দা থেকে কেউ সাড়া দেয় না।

জ্যোতির্ময় সরকার। ডাকনাম শুভম। পুরন্দর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এ বার তার মাধ্যমিক দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কথা রাখেনি শুভম। কথা রাখেনি বর্ষার কানা ময়ূরাক্ষী। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে মাঝ নদীতে টলমল করল নৌকা। নৌকায় ৩৫ জন পড়ুয়ার মধ্যে শুভমও ছিল। দু’টো সাইকেল ছিল। মাঝি ছিল না। নিজেরাই দড়ি টেনে টেনে পাড়ের দিকে আসছিল। তারপরেই বিপত্তি। টলতে টলতে নৌকাটা ডুবে গেল। কেউ সাঁতরে পাড়ে পৌঁছেছিল। কেউ পেয়েছিল ভরসার হাত। জ্যোতির্ময় পায়নি। সে সাঁতার জানত না। জলে পড়ে যাওয়ার পরে শরীরটা আটকে গিয়েছিল সাইকেলে। বেরোতে পারেনি সে।

তাকেও দেখতে পায়নি কেউ। তারপর গহীন জলে খাবি খেতে খেতে অসাড় হয়ে যায় রোগাপাতলা শরীরটা। নীল-সাদা পোশাক পরা ছেলেটি যখন ভেসে উঠেছিল ততক্ষণে সব শেষ।

আচ্ছা স্বপ্নের রং নাকি নীল?

আঁতকে ওঠেন আহ্লাদী, ‘‘এক্কেবারে না! ওটা মৃত্যুর রং। নীল রংটাই তো সব শেষ করে দিল।’’

শুধু কি হরবোলা? লেখাপড়া, ছবি আঁকা সবকিছুতেই শুভম অন্যদের থেকে কয়েক যোজন এগিয়ে থাকত। কেউ তাকে বাধ্য করত না। যা করত ভালবেসেই করত।

১৬ অগস্ট, ২০১৫। আচমকা শুভম নিজের ছবি এঁকে বসল। ছবিতে সেই নীল রং!

১৬ অগস্ট, ২০১৬। বিকেলে ফিরল শুভমের নিথর দেহ। চোখ দু’টোতে যেন কেউ নীল গুলে দিয়েছে।

নীলকন্ঠ পাখি পাক খায় সরকার বাড়ির ছাদে। অথচ এই বাড়িতেই পুজো আসেনি।

পুজো আসেনি গয়েশপুরের গোকুলপুরের আটপৌরে বাড়িটাতেও।

শরতের আকাশে এ বাড়ির ছাদে উড়ছে দীর্ঘ লেজওয়ালা ঘুড়ি।

কী সমাপতন! ঘুড়ির রংটাও নীল।

ধু-ধু ছাদে লাটাই হাতে আনমনা ছেলেটি কি কাঁদছে?

আচমকাই ঘুড়ির সুতোটা সে ছিঁড়ে দেয়। দূরে, আরও দূরে, আকাশের গায়ে মিলিয়ে যায় নীল ঘুড়ি। রাতের অন্ধকারে যে আকাশের দখল নেবে অসংখ্য তারা।

মরে গেলে সব্বাই কি তারাদের দেশে যায়?

আচ্ছা, রাতের আকাশেও কি উড়ালপুল থাকে?

৩১ মার্চ, ২০১৬। হুড়মুড় করে ভেঙে পড়েছিল কলকাতার নির্মীয়মাণ উড়ালপুল।

চাপা পড়ে যে ২৩ জন মারা গিয়েছিলেন সেই তালিকায় ছিলেন গোকুলপুরের সুজিত দেবনাথও। কাপড়ের দোকানি সুজিত সপরিবার পঞ্জাবে বেড়াতে গিয়েছিলেন। ফিরেছিলেন ট্রেনে। তারপর হাওড়া থেকে বাড়ি ফিরছিলেন গাড়িতে। পোস্তাতে এসেই সব অন্ধকার।

বিষণ্ণ দুপুরে সুজিতের স্ত্রী রিঙ্কি বলে চলেছেন, ‘‘কী স্বার্থপর ভাবুন! আমরা সবাই ফিরে এলাম। ওই শুধু মাঝ পথ থেকে চলে গেল! একটা উড়ালপুলই আমার জীবনটাকে তছনছ করে দিল।’’

চোখ মোছেন রিঙ্কি।

‘‘ও মা, তুমি কাঁদছ? দাঁড়াও, পাপা বাড়ি এলেই আমি বলে দেব।’’ পাশে বসে গিন্নিপনা করছে আড়াই বছরের রূপসা।

সে এখনও বিশ্বাস করে বাবা বাড়ি ফিরবে। তাকে কোলে করে ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যাবে।

সাত বছরের শুভ্রজিৎ অবশ্য জানে তার ‘পাপা’ আর কোনও দিন বাড়ি ফিরবে না। তারাদের দেশে এক বার চলে গেলে আর কি ফেরা যায়?

যায় না। কিন্তু যোগাযোগও কি করা যায় না?

শুভ্রজিৎ রোজ ইচ্ছে করেই ঘুড়ির সুতোটা কেটে দেয়। ঘুড়িতে লেখা থাকে—বাবা, কিচ্ছু ভাল্লাগছে না...

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন