বাবার কোলে করে পরীক্ষার হলে। —নিজস্ব চিত্র
গোটা বাড়ি মাথায় করে রাখতো দস্যি ছেলেটা। এ ঘর থেকে ও ঘরে সারাক্ষণ ছুটে বেড়ানো।
‘‘হঠাৎ কী যে হল’’—কাঁপা কাঁপা গলায় বলছেন মহিলা।
—‘‘সবে যখন চার বছর...এক দিন আধো আধো গলায় বলল, মা পায়ে খুব ব্যথা। সেই শুরু।’’
তার পর একে একে পা, কোমর, দু’টো হাত... সব অসাড় হয়ে গিয়েছে করিমপুরের আনন্দপল্লীর স্যমন্তক সরকারের।
দেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ছুটে, ডাক্তার থেকে কবিরাজ— হত্যে দিয়েও ছেলেটাকে আর দু’পায়ে দাঁড় করানো যায়নি। ‘‘তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল সব। কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে... কিছুই ঠাহর করতে পারছিলাম না,’’ সুব্রত আর সঞ্চিতা, স্যমন্তকের বাবা-মা’র আক্ষেপ।
বছর ঘুরতেই অবশ্য তাঁরা জানতে পেরেছিলেন, ‘ডুসেন মাস্কুলার ডিসট্রফি’, রোগটা সারে না।
দু’টো হাতই অবশ। আঙুলে জোর নেই। এ নিয়েই এ বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে করিমপুর জগন্নাথ উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রটি। বোর্ডের অনুমতি নিয়ে স্কুল তার হয়ে লেখার জন্য ‘রাইটার নেওয়ার’ অনুমতি দিয়েছে।
সেনপাড়া রাধারানি স্কুলের একটা আলাদা ঘরে পরীক্ষা দিচ্ছে স্যমন্তক। বাবা কোলে করে স্কুলের ওই ঘরটায় বসিয়ে দিয়ে যান। তার পর দাঁতে দাঁত চেপে টানা তিন ঘণ্টা...।
পেশায় স্কুল-শিক্ষক সুব্রতবাবু বললেন, “আমার এক মাত্র ছেলে। ছোটবেলায় সর্বত্রই জানিয়ে দিয়েছে, এ রোগের চিকিৎসা নেই।’’
ডাক্তারবাবুরা জানিয়ে দেন, যত দিন যাবে শরীরের সমস্ত অঙ্গ আস্তে আস্তে অকেজো হয়ে যাবে। প্রথম দিকে কিছু দিন স্কুলে গিয়েছিল। তার পর সেটাও বন্ধ হয়ে যায়। তা-ও বছর সাতেক হয়ে গেল। তার পর থেকে বাড়িতে বসেই পড়াশোনা।
সুব্রতবাবু জানালেন, ক্রমশ শরীরের অবনতি হচ্ছে। বেশির ভাগ সময়ই শুয়ে থাকতে হয় এখন। বসতেও কষ্ট। সেটাও করে দিতে হয়। শোওয়া থেকে বসা বা উল্টোটা, কিছুই একা করতে পারে না। সবটাই করে দিতে হয়।
এত কষ্টের মধ্যেও ছেলের পড়াশোনা নিয়ে আগ্রহ দেখে স্কুলের শিক্ষকরা এগিয়ে এসেছেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষক স্বাগত অধিকারী বলেন, ‘‘ওর লড়াইটা সেলাম করার মতো। এর মধ্যেও তো পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে।’’
সঞ্চিতাদেবীর কথায়, “ছোটবেলায় নিজের রোগটা সম্পর্কে তেমন কিছু বুঝত না। এখন বড় হচ্ছে, ক্রমশ বেঁচে থাকার ইচ্ছে হারাচ্ছে। নিজের বইটাও যে তুলতে পারে না।” তাঁর আক্ষেপ, “বহু টাকা খরচ করেও ছেলেটাকে সুস্থ করতে পারলাম না। জমা টাকাপয়সা সব শেষ হয়ে গিয়েছে। সরকারের কাছে আজ পর্যন্ত কোনও সাহায্য পাইনি। যদি ওরা একটু কিছু দেখতো।”
সবই জানে স্যমন্তক। বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে ইচ্ছে করে তার। কিন্তু বিছানা ছেড়ে ওঠার ক্ষমতাই নেই। গল্পের বইয়েই তাই বুঁদ হয়ে থাকে ছেলে। প্রিয় চরিত্র ফেলুদা।
মা-বাবার কষ্টটাও বোঝে সে। আর তাই লড়াইয়ের ময়দান এতো সহজে ছেড়ে দিতে নারাজ।
লাজুক হেসে বলল, ‘‘বাংলা, ইংরাজি, ইতিহাস পরীক্ষাটা ভালই দিয়েছি। দেখা যাক, বাকিটা কেমন হয়। বড় হয়ে আমি জ্যোতির্বিজ্ঞানী হব।’’ সব ছেড়ে দিলেও ওই স্বপ্নটা ছাড়েনি ছেলেটা।