যুযুধান: মহরমের লাঠিখেলা। নিজস্ব চিত্র
কাঁপছে কারবালার মাঠ।
‘‘মার ঘুরিয়ে, মার! লাঠি চালাতে শিখিসনি হতচ্ছাড়া? আয় না উঠে, তোরই আমি মাথা ভাঙব!’’
মাঠের ধারে রণং দেহি নারায়ণ দাস। মহরমের মাঠে সরশাবাদ দলের ক্যাপ্টেন। আগে নিজেই লাঠি ধরে ঘোরাতেন সাঁই সাঁই। বয়স ষাট পার। এখনও আর মাঠে নামেন না, কিন্তু বাইরে থেকেই চালান গোটা খেলা।
দলের ধলু শেখের কথায়, ‘‘আরে, নারানদাই আমাদের দলের স-অ-ব। প্রতিপক্ষের চেয়ে ওঁকেই বেশি ভয়। মাঠের ধারে যা ছটফট করতে থাকেন, হারলেই যেন লাঠিপেটা করবেন!’’
একাদশীর দুপুরেই ভৈরব পেরিয়ে ইসলামপুর নশিপুর কারবালা মাঠে লাঠি-তলোয়ার হাতে এসে হাজির সরশাবাদের দল। সামনে নারান দাস। জাতি হিন্দু। নিজে তিনি সরশাবাদের লোকও নন। ভৈরব পার হয়ে নশিপুর যেতে যে চক ইসলামপুর পড়ে, তাঁর বাড়ি সেখানেই।
শুরুটা বছর পনেরো আগে। গোধরার দাঙ্গার আগুন নিভেছে, কিন্তু তখনও ভয়ের আবহাওয়া চারদিকে। এ দিকে চক ইসলামপুরের নামেই শুধু ইসলাম, পুরোদস্তুর হিন্দু এলাকা। তা পার হয়ে নশিপুর যেতে খানিক ভয়ই পাচ্ছিল সরশাবাদের দল। ঠিক তখনই এগিয়ে আসেন নারায়ণ। তখন তিনি জমি রেজিস্ট্রি অফিসের কর্মী। সকলে মান্যি করে। তিনি সামনে গেলে কে আর ঝামেলা পাকাবে?
সেই থেকে চলছে। তবে নারায়ণ একা নন। চক হড়হড়িয়ার গোলামের দলের হয়ে লাঠি আর তলোয়ার দুই-ই খেলতেন হোমগার্ড মুকুল দেবনাথ। অবসর নিয়েছেন অনেক দিন হল, এখন আর শরীরে দেয় না। পনেরো-বিশ বছর আগে নশিপুর দলকে খেলা শেখাতেন ব্রজ ঠাকুর, তিনি প্রয়াত। বুড়া জমাদার লাঠি খেলতেন জমাদার পাড়ার দলের হয়ে।
ফি বছর সোলেমান হকের সঙ্গে বিচারকের আসনে থাকেন ধীমান দাসও। এ বার তিনি পুজো কাটাতে মেয়ের কাছে কলকাতায়। তাতেই মনখারাপ সাকিবুল, নুরাবুল, মির জামিলদের— ধীমানদা না থাকলে চলে? ওই মেলা কমিটির সম্পাদক মাসিদুল শেখ বলেন, ‘‘এই পরবে নারায়ণ দাস, বিশ্বনাথ মণ্ডল, ধীমান দাসেরা থাকবেন, এটাই স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে অনেক দিন।’’
যেমন স্বাভাবিক নবমীর সন্ধ্যায় এলাকার বিভিন্ন ঠাকুর দালানে পৌঁছে যাবেন নব্বই ছুঁই-ছুঁই সোলেমান সাহেব। না হলে ভক্তদেরই মনে হবে, কী যেন হল না!
যেমন স্বাভাবিক চক ইসলামপুর থেকে উবে যাওয়া ভয়ের হাওয়া। এক দিন রক্ষাকবচ হয়ে পথে নামতে হয়েছিল ক্যাপ্টেন নারানকে। ‘‘এখন আসা-যাওয়ার ওখানকার লোকেরাই ধরেন— একটু খেলা দেখিয়ে যাও না গো!’’— বলে হাসেন ধলু।
বড় ঝলমলে সেই হাসি!