দু’সপ্তাহে তৈরি হয় ছোট-বড় চারশো প্রতিমা

এক রাতেই সারা চক্ষুদান, অঙ্গসজ্জা

হাতে গুনে বাকি আর মাত্র তিনটে দিন। অথচ, নবদ্বীপের রাসের অধিকাংশ প্রতিমা এখনও অসম্পূর্ণ। বেশির ভাগেরই সবে মাটির উপর রং চড়েছে। চক্ষুদান বাকি, সাজপোশাক তারও পরে। হঠাৎ করে দেখলে সংশয় জাগে, কী করে শেষ হবে এই বিশালাকায় এত প্রতিমার নির্মাণ!

Advertisement

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৮ ০২:৩৩
Share:

পাঁচ দিনে একটা মূর্তি শেষ করতে পারা নবদ্বীপের শিল্পীদের নিজস্ব উত্তরাধিকার। নিজস্ব চিত্র

হাতে গুনে বাকি আর মাত্র তিনটে দিন। অথচ, নবদ্বীপের রাসের অধিকাংশ প্রতিমা এখনও অসম্পূর্ণ। বেশির ভাগেরই সবে মাটির উপর রং চড়েছে। চক্ষুদান বাকি, সাজপোশাক তারও পরে। হঠাৎ করে দেখলে সংশয় জাগে, কী করে শেষ হবে এই বিশালাকায় এত প্রতিমার নির্মাণ! ও দিকে, বৃহস্পতিবার রাত থেকেই রাসের নিশিপুজো শুরু হওয়ার কথা।

Advertisement

যদিও নবদ্বীপের রাসের হালহদিস যাঁরা জানেন, তাঁরা জানেন ঠিক সময়ের আগেই সব প্রতিমা নিখুঁত ভাবে সম্পূর্ণ হয়ে যাবে। এখানেই নবদ্বীপের মৃৎশিল্পীদের বিশেষত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব। ছোট-বড় মিলিয়ে নবদ্বীপে রাসে প্রায় চারশো প্রতিমা তৈরি হয়। তা-ও মাত্র দু’সপ্তাহের মধ্যে। উচ্চতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নজরকাড়া গড়নের রাসের প্রতিমা অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে তৈরি করতে জানেন এখানকার প্রতিমা শিল্পীরা। পনেরো-বিশ হাত উচ্চতার প্রতিমার খড়ের কাঠামো বাঁধা থেকে, চক্ষুদানের মতো যাবতীয় পর্যায় অবলীলায় সাত দিনে শেষ করাই নবদ্বীপের মৃৎশিল্পীদের রেওয়াজ।

নবদ্বীপের রাসের অন্যতম বড় প্রতিমা আমড়াতলার মহিষমর্দিনী, হরিসভার ভদ্রাকালী বা যোগনাথ তলার গৌরাঙ্গিনী মাতার মতো বড় প্রতিমার খড় বাঁধার কাজ শুরু করা থেকে একমেটে, দো-মেটে, আঙুল বসানো হয়ে যায় দিন চারেকের মধ্যেই। দিন দুয়েক বাদে ফের শুরু হয় রঙের কাজ। সকাল কাজ শুরু করে পাক্কা চব্বিশ ঘণ্টায় প্রতিমার চক্ষুদান পর্ব শেষ। তার পর সাজ, অস্ত্র পরিয়ে ভারা খুলে নেমে আসতে আর কতক্ষণ?

Advertisement

আমড়াতলার মহিষমর্দিনীর আঠাশ ফুট উচ্চতার প্রতিমার গায়ে প্রাথমিক রঙের প্রলেপটুকুই পড়েছে মঙ্গলবারে। যদিও উদ্যোক্তারা জানালেন রাতেই মধ্যেই প্রতিমা সম্পূর্ণ হয়ে যাবে। ঘরের পাশেই কৃষ্ণনগর, মৃৎশিল্পের সূক্ষ্মতার জন্য জগৎ বিখ্যাত। কিন্তু নবদ্বীপের মৃৎশিল্পের উপর ঘূর্ণির সামান্যতম প্রভাব পড়েনি।

গঙ্গার দু’পারে মৃৎশিল্পের দুই ভিন্নমুখী ধারার ইতিহাস খুঁজতে পিছিয়ে যেতে হয় কমপক্ষে আড়াইশো বছর। আদিতে নবদ্বীপের রাসে পটপূজা হত। বলা হয়, সে সময় নাকি নবদ্বীপে মৃৎশিল্পীরা ছিলেন না। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমন্ত্রণে মৃৎশিল্পীরা নাটোর থেকে নবদ্বীপে এসে বসবাস শুরু করেন। প্রায় একই সময়ে পর পর উৎসব হওয়ায় শিল্পীরা নিজেরাই উদ্ভাবন করেছিলেন দ্রুত প্রতিমা নির্মাণের কৌশল। নবদ্বীপের মৃৎশিল্পীরা সেই ধারাই বয়ে নিয়ে চলেছেন।

গবেষক মোহিত রায় থেকে প্রখ্যাত কার্টুনিস্ট চণ্ডী লাহিড়ী— সকলেই লিখেছেন বড় মূর্তি নির্মাণে অঙ্গের আনুপাতিক মাপ এবং শিল্পসুষমা বজায় রাখায় নবদ্বীপের শিল্পীদের দক্ষতা কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে। এ সম্পর্কে গবেষক সুধীর চক্রবর্তী লিখছেন, “মূর্তির অবয়ব গঠনে মৃৎশিল্পীর দক্ষতা প্রশ্নাতীত।... এ গঠনে ধরা আছে বহুদিনের রক্তগত জাতিবিদ্যার অহংকার।”

নবদ্বীপের অন্যতম মহেন্দ্র পালের চতুর্থ প্রজন্মের শিল্পী দেবাশিস বলেন, ‘‘আসলে নবদ্বীপের মূর্তিনির্মাণ শৈলীর কিছু নিজস্ব কৌশল পুরুষানুক্রমে চলে আসছে। পাঁচ দিনে একটা মূর্তি শেষ করতে পারা নবদ্বীপের শিল্পীদের নিজস্ব উত্তরাধিকার।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন