ভুয়ো বিচারক সেজে পাকড়াও কৃষ্ণনগরে

শুধু লালবাতি লাগিয়ে ঘোরা বা গাড়ির পিছনে ‘গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া’ লেখা নয়। রীতিমত ‘কাউন্সিল’ বসিয়ে গ্রামীণ চিকিৎসকদের ‘বিচার’ করারও ব্যবস্থা করে ফেলেছিলেন তিনি। কিন্তু বাদ সাধল সিআইডি।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০১৬ ০১:৩৭
Share:

সিআইডির হেফাজতে লাল বাতি লাগানো গাড়ি। সিল করে দেওয়া হয়েছে বাড়িও। ইনসেটে, শ্যামল দত্ত। —নিজস্ব চিত্র।

শুধু লালবাতি লাগিয়ে ঘোরা বা গাড়ির পিছনে ‘গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া’ লেখা নয়। রীতিমত ‘কাউন্সিল’ বসিয়ে গ্রামীণ চিকিৎসকদের ‘বিচার’ করারও ব্যবস্থা করে ফেলেছিলেন তিনি। কিন্তু বাদ সাধল সিআইডি।

Advertisement

জাল অশোকস্তম্ভ ব্যবহার, সরকারি নথি জাল করা ও সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার অভিযোগে বৃহস্পতিবার কৃষ্ণনগর থেকে সেই নকল বিচারককে গ্রেফতার করা হয়েছে।

পুলিশ জানায়, ধৃতের নাম শ্যামল দত্ত। বাড়ি কৃষ্ণনগরেরই কোতোয়ালি থানার জাভা এলাকায়। তাঁর ভুয়ো কাউন্সিলের দুই সদস্যও ধরা হয়েছে। তাঁদের নাম দিব্যেন্দু হাজরা ও রঞ্জিত বিশ্বাস। দু’জনেই শান্তিপুরে বাসিন্দা।

Advertisement

সিআইডি সূত্রের খবর, ২০১৪ সাল থেকেই শ্যামল দত্ত নিজেকে কেন্দ্রীয় মেডিক্যাল কাউন্সিলের প্রধান বিচারপতি বলে পরিচয় দিয়ে মানুষকে প্রতারণা করছিলেন। একটি ‘গেজেট নোটিফিকেশন’ দেখিয়ে তিনি দাবি করতে থাকেন যে সেই নির্দেশ বলেই তিনি ‘বায়োকেমিক এডুকেশন গ্রান্ট কমিশন’-এর প্রধান বিচারপতি। এর বলেই তিনি কৃষ্ণনগরকে সদর দফতর করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ৭৮টি কলেজ খুলেছেন। সেগুলিকে ‘রেজিস্ট্রেশন’ও দিয়েছেন।

শান্তিপুরেও বছরখানেক আগে তিনি একটি কলেজ খোলেন। এখন সেখানে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ৭০। গোয়েন্দারা জেনেছেন, কৃষ্ণনগর ও করিমপুরেও কলেজ খোলার চেষ্টা চলছিল । ওই সব কলেজে ভর্তির পাশাপাশি নানা সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে চাকরি দেওয়ার নাম করে মোটা টাকা তোলা হত। বিভিন্ন গ্রামীণ চিকিৎসককে মোটা টাকা জরিমানা করার হুমকি দেওয়াও শুরু হয়েছিল বলে অভিযোগ।

এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের কাছে ‘আরটিআই’ করে এই সংস্থা সম্পর্কে জানতে চান অনেকে। তদন্তকারী এক সিআইডি অফিসারে কথায়, ‘‘স্বাস্থ্য মন্ত্রক ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) নিজেদের মতো তদন্ত করে। স্বাস্থ্য মন্ত্রক রাজ্য সরকারকে চিঠি লিখে জানিয়েছে যে, এমন কোনও সংস্থার অনুমোদন তারা দেয়নি। একই কথা জানায় ইউজিসি-ও। তার পরেই সিআইডি-র উপরে তদন্তের ভার দেওয়া হয়।’’

সেই মতো মাস দুয়েক আগে সিআইডি-র একটি বিশেষ তদন্তকারী দল গড়া হয়। ডিআইজি (সিআইডি) ভরতলাল মিনা বলেন, ‘‘তদন্তে নেমে দেখা যায়, ওই সংস্থাটি সম্পুর্ণ ভুয়ো। তাদের কাছে কোনও অনুমোদন নেই। সমস্ত ভুয়ো নথি তৈরি করে মানুষকে প্রতারণা করা হচ্ছে। এই বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার পরেই ওই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’’

সম্প্রতি ইউজিসি-র পক্ষ থেকেও কোতোয়ালি থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়। বিষয়টি নজরে আসায় তার আগে থেকেই তদন্তে নেমে পড়েছিল জেলা পুলিশ। নদিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অজয় প্রাসাদ বলেন, ‘‘আমরাও বিভিন্ন দফতরকে চিঠি লিখে প্রকৃত তথ্য জানতে চেয়েছি। সিআইডি-ও তদ‌ন্ত করছিল। গোটা বিষয়টি যে ভুয়ো সেটা নিশ্চিত হয়েই ওরা লোকটিকে গ্রেফতার করেছে।’’ তবে গেজেট নোটিফিকেশনটি জাল কিনা সে বিষয়ে এখ‌নও নিশ্চিত হতে পারেনি সিআইডি বা পুলিশ।

এ দিন কৃষ্ণনগরের বৌবাজারে শ্যামল দত্তের প্রধান কার্যালয় তথা ‘আদালতে’ হানা দিয়ে তাঁকে ধরে সিআইডির বিশেষ দল। বেশ কিছু জাল নথিপত্র ও অশোকস্তম্ভের শিলমোহরও পাওয়া যায়। রাতেই অফিসটি ‘সিল’ করে দেওয়া হয়। শান্তিপুরে অভিযান চালিয়ে বাড়ি থেকে বাকি দু’জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এর মধ্যে দিব্যেন্দু হাজরা শান্তিপুরের কলেজটিক সুপার ছিলেন আর রঞ্জিত বিশ্বাস ভুয়ো কাউন্সিলের সম্পাদক পদে ছিলেন বলে সিআইডি সূত্রের খবর।

ধৃত শ্যামল দত্ত অবশ্য এখনও নিজেকে কেন্দ্রীয় মেডিক্যাল কাউন্সিলের প্রধান বিচারপতি বলেই দাবি করছেন। সিআইডি তাঁকে আটক করার পরেও তিনি বারবার বলেছেন, ‘‘আমি কোনও অন্যায় করিনি। এটা যে একটি ভারত সরকারের সংস্থা তা পরে ঠিক প্রমানিত হবে। আমি প্রধান বিচারপতি। তা হলে, কেন গাড়িত লাল বাতি জ্বালাব না?’’

ঘটনাচক্রে, এ দিন তাঁর ‘কমিশন’ থেকে রেজিস্ট্রেশন নিয়ে কলেজ করবেন বলে চেন্নাই থেকে কৃষ্ণনগরে এসেছিলেন এক ব্যক্তি। কিন্তু এখানে এসে তিনি শোনেন, শ্যামল দত্তকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিষয়টি ভাল করে জানতে তিনি কোতোয়ালি থানাতেও হাজির হন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের ওখানেও এমনই একটা বায়োকেমিক কলেজ খুলেছে। সেটা দেখেই আমি উৎসাহিত হই। নতুন একটা কলেজ খোলার জন্য রেজিস্ট্রেশন নেব বলে খোঁজখবর করতে এসেছিলাম। এখন তো শুনছি, পুরোটাই ভুয়ো।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন