যত দিন গাড়ি টানার শক্তি থাকবে, কদর তত দিনই। ছবি: গৌতম প্রামাণিক
চোঁ চোঁ করে বাড়ছে গরুর টিআরপি।
অবস্থা এমন যে, জাতীয় পশু গরু না বাঘ? একটু গুলিয়েই যাচ্ছে আপামর দেশবাসীর কাছে। অবলা চতুষ্পদের উপর কদরটা কিঞ্চিৎ বেড়েই গিয়েছে ক’দিনে। প্রশ্নটা হল, গরু ছাড়া তো দেশে আরও অবলা চতুষ্পদ রয়েছে। তাদের দুঃখ-কষ্টের দিকে একটু চোখে ফেরালে অবাকই হতে হচ্ছে, কী নিদারুণ অবহেলায় চুপচাপ মরে যাচ্ছে তারা।
কলকাতা কিংবা শহরতলিতে কুকুর নিয়ে মাঝেমধ্যে হইচই হয়, প্রত্যন্ত গ্রাম-মফস্সলে তেমন হইচই নেই বটে, তবে, বাতিল ঘোড়া, ধর্মের নামে ছেড়ে দেওয়া ষাঁড়, কী করুণ দিন কাটাচ্ছে, জানলে শিউরে উঠতে হয়।
বাতিল বা ছেড়ে দেওয়া সেই সব পশুর কোনও মালিক নেই। সব পাখি ঘরে ফেরে। আস্তানায় ফেরে অন্য পশু, হাঁস, মুরগি। কিন্তু বাতিলদের তো কোনও ঠিকানা নেই। রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে তারা ঘুরে বেড়ায় চরাচরে। নিজের খাবার নিজেরাই জোগাড় করে, গ্রামের শুকনো নির্ঘাস মাঠে, আস্তাকুঁড়ে, আবর্জনার ভাঙা গামলায় মুখ ডুবিয়ে। তা-ও নজরে পড়লে তাদের দু’ঘা কষিয়ে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারেন না অনেকেই।
নদিয়া-মুর্শিদাবাদের মাঠ-ঘাটে এমনই বাতিল ঘোড়ার ভিড়। নিশুতি রাতে তাদের একলা অথবা দলবদ্ধ, মহীনের ঘোড়া হয়ে চরে বেড়াতেও দেখা যায়। আবাদি জমিতে নামলে যে বাঁশ-কাঠের শাসন অপেক্ষা করছে তা জানে মহীনের ওই ঘোড়ারা। মুদির দোকানের সামনে তাই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়, চেনা ভিক্ষুর মতো। তবে, বিরক্ত দোকানির গায়ে ঢেলে দেওয়া গরম জলের দাগ বয়ে নিয়ে বেড়ায় তাদের অনেকে।
দাপুটে সেই অশ্ব-কুল যত দিন এক্কা বা আবাদি জমিতে চাষের কাজে লাগে, ততদিন তোয়াজ আছে তাদের। তার পরেই কদর শেষ। মাঠ-ঘাটই তখন তাদের ঠিকানা। অভাবের সংসারে এমন অপুষ্যিকে কে আর বসিয়ে খাওয়াবে? কে-ই বা কিনবে বুড়ো ঘোড়াকে? তার পর এক নিশুতি রাতে ঘোড়ার মালিক সেই ঘোড়াকে ছেড়ে দিয়ে আসেন দূরের কোনও মাঠে। যাতে পথ চিনে আর ঘরে ফিরতে না পারে।
মালিকের সঙ্গে আচমকা এমন নৈশ ভ্রমণে কখনও সে বেচারা বেরোয়নি। কিন্তু মালিকের উপর তার অগাধ বিশ্বাস। দূরের জঙ্গলে কচি ঘাসে সীতা, দুলদুল কিংবা লায়লা নিশ্চিন্তে মুখ ডোবাতেই চোরের মতো চুপিসাড়ে বাড়ি ফেরার পথ ধরে ঘোড়ার মালিক। বেশ কিছুক্ষণ পরে ঘাস থেকে মুখ তুলে মালিককে খোঁজে বুড়ো ঘোড়া—চিঁহি।
কে শুনছে সে ডাক!