সম্প্রীতির কালীপুজো বাঁচাতে একজোট ওঁরা

সেই বাপ-পিতেমোর আমল থেকেই টলটলে ভৈরবের দুই পাড়ে ওঁদের বাস। দেশভাগের আঁচ লাগেনি মুর্শিদাবাদের ‘সিল্ক গ্রাম’-এর হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির ঠাস বুনোটে।

Advertisement

অনল আবেদিন

শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০১৬ ০১:৪৫
Share:

সেই বাপ-পিতেমোর আমল থেকেই টলটলে ভৈরবের দুই পাড়ে ওঁদের বাস। দেশভাগের আঁচ লাগেনি মুর্শিদাবাদের ‘সিল্ক গ্রাম’-এর হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির ঠাস বুনোটে।

Advertisement

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দামামা প্রায় কাঁপিয়ে দিল ভৈরবের দুই পাড়। বহুদিনের সম্প্রীতি এবার বুঝিবা চিড় খায়। রাজাকারদের তাড়া খেয়ে দলে দলে উদ্বাস্তুরা জড় হচ্ছেন ভৈরবের পাড়ে। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে তাঁদের গোলমাল শুরু হল।

কিন্তু তা আর বাড়তে দিলেন না স্থানীয়রাই। এগিয়ে এলেন দুই সম্প্রদায়েরই মানুষ। শরৎ পার হয়ে হেমন্তের হিমেল হাওয়া ভৈরবের জলে ঘায় মেরে যাচ্ছে। নিস্তরঙ্গ ভৈরবকে অশান্ত হতে দিলেন না তাঁরা।

Advertisement

ইসলামপুরে আচমকা বাঁক খাওয়া ভৈরবের পূর্ব ও উত্তর পাড়ে জগৎখ্যাত মুর্শিদাবাদ সিল্কের শিল্পীদের গ্রাম— চক ও ইসলামপুর। পশ্চিম ও দক্ষিণ পাড়ে কৃষিজীবীদের গ্রাম— নওদাপাড়া, কলাডাঙা ও সরসাবাদ। ঠিক হল, যুগান্তের সম্প্রীতি টিকিয়ে রাখতে কালীপুজো হবে। সেই পুজোতে সামিল করা হল ছিন্নমূল হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষকে। একসময় হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের শুরু করা সেই পুজো পরিচালনার ভার পরবর্তীকালে হিন্দুদের হাতেই যায়। সেই কালীপুজো এ বার ৪৫-এ পা দিল।

কিন্তু, এ বছরেই বন্ধ হতে বসেছিল সেই পুজো। কারণ, আয়োজকদের কেউ বৃদ্ধ হয়েছেন, কারওর মৃত্যু হয়েছে। বর্তমান প্রজন্মের ছেলেদের অনেকেই বাইরে। ফলে, ‘বুড়োরা’ আর পুজো চালিয়ে যেতে পারছিলেন না। ইসলামপুর বাজারের ব্যবসায়ীরা প্রতিবছর ইদ-বিজয়া-মহরম সম্মিলনীর আসর বসান। সেই আসরেই কালীপুজোর আয়োজকরা জানিয়ে দেন এবার আর পুজো করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। বন্ধ করে দেওয়া হল।

নিশ্চিতভাবে বন্ধ হওয়া থেকে পুজো বাঁচাতে এগিয়ে এলেন বাজারেরই ব্যবসায়ী নাজমুল হক, আয়ুব আলি, আবু হায়াত, আবু তালেব মণ্ডল- সহ অনেকেই। বন্ধ হওয়ার কথা উঠতেই তাঁরা জানালেন, সম্প্রীতির ঐতিহ্য যে কালীপুজো, তা বন্ধ করা যাবে না। জানালেন, দায়িত্ব তাঁরাই নেবেন। নাজমুল হককে সম্পাদক, আয়ুব আলিকে সহ-সম্পাদক, শঙ্কর মণ্ডলকে সভাপতি ও অমল সাহাকে কোষাধ্যক্ষ করে গড়া হল ‘ইসলামপুর ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতি শ্যামাপুজা কমিটি’।

এলাকার বাসিন্দারা জানালেন, হিন্দু প্রধান চক-ইসলামপুরের চারপাশের ২০-২৫টি গ্রাম মুসলিম প্রধান। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাড়া খেয়ে স্রেফ প্রাণটুকু হাতে করে পালিয়ে আসা সহায়-সম্বল হীন লক্ষাধিক মানুষের হঠাৎ কলোনি গড়ে ওঠায় সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দাদের গোলমালে পরিবেশ অশান্ত হয়ে ওঠায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন এলাকার বাসিন্দারা। সেই পুজো যে বন্ধ হওয়া থেকে বেঁচে গেল তাতে খুশী উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ।

প্রথম দিকে ৭ দিন ধরে পুজোপ্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত হত প্রতিযোগিতা মুলক যাত্রাপালা। তারপর ৪৫ বছর ধরে ভৈরব দিয়ে বিস্তর জল গড়িযেছে। সেই পুজোর জৌলুস ক্রমে ম্রিয়মান হয়েছে। তখনের ভরা ভৈরব আজ একফালি মরা নদীতে পরিণত। প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তাদের অনেকেই আজ আর নেই। পুজো কমিটির শঙ্কর মণ্ডল বলেন, ‘‘আজ আর আগের সেই জৌলুস নেই। গত কয়েক বছর ধরে নমো নমো করে পুজো হত। এবার যে তালেবরা এগিয়ে এলেন এতেই প্রমাণিত আমাদের সম্প্রীতির বাঁধন কতটা মজবুত।’’

দশমীর দিন নদীর দু’পাড়ে মেলা বসে। মুসলিম প্রধান এলাকা হওয়ার জন্য মেলার জনসমাগমের শতকরা ৭০ ভাগই মুসসিম সম্প্রদায়ের। আয়ুব আলি বললেন, ‘‘উৎসবের কোনও ধর্ম হয় না। ফলে আয়োজনের লোক কমে গিয়েছে বলে পুজো বন্ধ হতে দেব না।’’ তির তির করে বয়ে যাওয়া ভৈরব আজও ন্যুব্জ শরীরে সম্প্রীতির বার্তা বয়ে নিয়ে চলেছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement