গোপালের জন্য পছন্দসই রপোশাকের খোঁজ। বহরমপুরে তোলা নিজস্ব চিত্র।
সবে শেষ হয়েছে কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধ। দেশ জুড়ে পাণ্ডবদের শাসন প্রতিষ্ঠিত। সিংহাসনে কুরুকুলপতি যুধিষ্ঠির। এমন সুখের সময়ে পান্ডবসখা কৃষ্ণের জন্মদিন সাড়ম্বরে উদ্যাপনের ইচ্ছে প্রকাশ করলেন যুধিষ্ঠির। প্রবল উৎসাহে সমর্থন জানালেন বাকি চার পাণ্ডবও। সমবেত সেই ইচ্ছার কাছে নতি স্বীকার করে উৎসব পালনে সম্মতি দেন কৃষ্ণ। শুধু তাই নয় এই উৎসবের নির্দেশিকাও নাকি স্বয়ং তিনি তৈরি করে দিয়েছিলেন। সেই মতো যুধিষ্ঠির রাজকীয় সমারোহে উদ্যাপন করেন কৃষ্ণের আবির্ভাব উৎসব—জন্মাষ্টমী।
সেই শুরু। প্রতি বছর এই তিথিতে রাতে দেবতা, প্রিয় হয়ে ওঠেন। কৃষ্ণ এই রাতে বাড়ির ছোট্ট শিশুটি হয়ে ভক্তদের ঘরে ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আবির্ভাবের প্রতীক্ষায় মথুরা থেকে মায়াপুর, নন্দপুরী থেকে নবদ্বীপে যেন অকাল কোজাগরী। সম্ভ্রমের দূরত্ব থেকে রোজকার মতো দেবার্চনা নয়। স্নেহে-সেবায়, প্রেমে-প্রীতিতে ভক্ত এই রাতে ছুঁতে চায় মহাকাব্যের এক মহানায়ককে।
ভরা ভাদরের এই বৃষ্টি ভেজা রাতে গঙ্গার পশ্চিম তীরের নবদ্বীপ বা পূর্ব পাড়ের মায়াপুরের মানুষ দু’চোখের পাতা এক করেন না। সকাল থেকেই সাজ সাজ রব। বুধবার থেকে মন্দিরে মন্দিরে শুরু হয়ে যায় কৃষ্ণের বাল্যলীলার পুনর্ভিনয় বা জন্মকথা পাঠ-কীর্তন। সে কীর্তনের ‘মহাজন পদে’ বা ‘আখরে’ ঝরে পড়ে পরমকে কাছে পাওয়ার আকুতি। মল্লার বা জয়জয়ন্তীতে বাঁধা কীর্তনের সেই অলৌকিক সুর সারারাত ভেসে বেড়ায় ফুলেফেঁপে ওঠা নদীর ঘাটে ঘাটে।
কস্তুরি চন্দন অগুরুর সঙ্গে মিশে যায় জুঁই বেলির সুবাস। সুর আর সুগন্ধে মাখামাখি শ্রাবণ সন্ধ্যা পায়ে পায়ে এগিয়ে চলে গভীর রাতের দিকে। ভক্তদের ভিড়ে ঢাকা পড়ে যায় মন্দিরের চাতাল।
তারপর অনেক রাতে অষ্টমী তিথি যখন রোহিণী নক্ষত্রে প্রবেশ করে, তখনই মাহেন্দ্রক্ষণ। মহাভিষেক শুরু হয়ে যায় মন্দিরে মন্দিরে। মধ্যরাতের স্তব্ধতা ভেঙে এক সঙ্গে বেজে ওঠে অগণিত শাঁখ। মৃদঙ্গ মন্দিরা করতাল ঘণ্টাধ্বনিতে নাটমন্দির থেকে নদীর দুই কিনার ছুঁয়ে গৃহস্থের ঠাকুরঘরে পৌঁছে যায় বার্তা—কৃষ্ণ জন্ম নিলেন। দেড়শোর বেশি মঠমন্দিরে সমবেত হাজার হাজার ভক্তের যাবতীয় উন্মাদনা কেন্দ্রীভূত হয় এক এবং অদ্বিতীয় কৃষ্ণকে ঘিরে।
উপলক্ষ এক হলেও উদ্যাপনের ধরন কিন্তু স্থান ভেদে ভিন্ন ভিন্ন। নবদ্বীপে উৎসব সর্বত্রই কৃষ্ণ নিয়ে এমনটা কিন্তু নয়। যেমন বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী সেবিত মহাপ্রভুর বিগ্রহকে কৃষ্ণ মনে করে জন্মাষ্টমী উদ্যাপিত হয় নবদ্বীপের মহাপ্রভু মন্দিরে। অভিষেকের সময় মহাপ্রভুকে পরানো হয় লাল চেলি। কেবল এই দিনের জন্য মহাপ্রভু হয়ে ওঠেন বংশীধারী। তেমনই রাধারমণ বাগ সমাজবাড়িতে বিশুদ্ধ বৃন্দাবনী ঘরানায় পালন করা হয় এই তিথি। আবার বলদেব মন্দিরে অভিষেক হয় বলদেব জিউর। হরিসভা মন্দির, গোবিন্দবাড়ি, দেবানন্দ গৌড়ীয় মঠ বা কেশবজি গৌড়ীয় মঠ নিজের মতো করে পালন করে এই উৎসব।
গঙ্গার পূর্বপারের ইস্কন মন্দিরে জন্মাষ্টমীর উদযাপন আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠে নানাদেশের ভক্ত সমাগমে। বুধবার থেকে শুরু হয়েছে অধিবাস। বৃহস্পতিবার মায়াপুর ইস্কন মন্দিরে সারাদিন ধরে বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি, রাশিয়ান-সহ নানা ভাষায় শোনা যাবে কৃষ্ণকথা। গাওয়া হবে কীর্তন। অভিনীত হবে কৃষ্ণলীলা। ইস্কনের জন-সংযোগ আধিকারিক রমেশ দাস জানান, প্রায় তিরিশ হাজার মানুষ জড়ো হয়েছেন মায়াপুরে। তাঁদের জন্য মন্দির চত্বরে বসেছে একাধিক জায়ান্ট স্ক্রিন। বছরে ওই একদিনই সারারাত জাগে ইস্কন মন্দির। উৎসবের সূচনা হয় মহাস্নানের প্রস্তুতি পর্ব দিয়ে। কয়েক হাজার দেশি বিদেশি ভক্ত গঙ্গা থেকে আনেন মহাভিষেক বারি। জন্মাষ্টমীর সঠিক মুহূর্তে দুধ-ঘি-দই মধুর সঙ্গে গঙ্গাজল দিয়ে সম্পন্ন হয় মহাভিষেক পর্ব। তবে জন্মাষ্টমীতে ইস্কনের অন্যতম আকর্ষণ ‘পুষ্পাঞ্জলি’। অভিষেকের পরে বৃষ্টিধারার মতো বিগ্রহের ওপর ঝরে পড়তে থাকে গোলাপ-জুই-বেলি-কামিনী-চাঁপা ফুলে পাঁপড়ি। চারফুটের বিগ্রহ ঢাকা পড়ে যায় ফুলে ফুলে।
সমাজবাড়িতে বৃন্দাবনের মতো করেই উৎসব পালিত হয়। এখানে কৃষ্ণ যতটা ভগবান তার থেকে অনেক বেশি প্রিয় বালক। বাৎসল্য এবং মধুর রসে শ্রীকৃষ্ণের ভজনা করেন এই মন্দিরের সেবায়েতরা। এখানে উৎসবের দু’টি অংশ। দু’দিন ধরে উৎসব পালিত হয়। প্রথমদিন ব্রত এবং দ্বিতীয় দিন নন্দোৎসব। নবদ্বীপের চৈতন্য জন্মস্থান আশ্রম-সহ অনান্য মন্দিরগুলিতে উৎসবের ধাঁচ অনেকটা একই রকম। মঠের প্রধান তথা গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের সম্পাদক অদ্বৈত দাস বলেন, “যেখানে যে মতই অনুসরণ করা হোক না কেন, মঙ্গলারতি, কৃষ্ণের জন্মলীলা পাঠ, বিশেষ কীর্তন, অভিষেক, ভোগরাগ এই সব একই ভাবে উৎসবের অঙ্গ হিসেবে সর্বত্র পালন করা হয়।”
বর্ষার মরশুমে ঝুলনের পরেই জন্মাষ্টমী-নন্দোৎসব জোড়া উৎসবকে ঘিরে খুশি স্থানীয় ব্যবসায়ী মহলও।