‘খুশি হওয়ার লোকটাই তো নেই’

সেই মেয়েই এ বছর মাধ্যমিকে প্রথম চেষ্টাতে পাশ করেছে। এমন ভাগ্য বিপর্যয়ের সঙ্গে লড়াই করে পরীক্ষার চৌকাঠ একবারে পেরোতে পারবেন, এমন আশা কাছের মানুষেরা প্রায় কেউই করেননি। তাঁরা উচ্ছ্বসিত। শুধু মেঘ সরছে না অনিন্দিতার মনের। যে মানুষটি এ দিন সবচেয়ে খুশি হতেন তাঁকে আর কোনওদিনই কাছে পাবেন না।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০১৮ ০১:৪০
Share:

অনিঞ্জিতা মণ্ডল। ফাইল চিত্র

সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে নিজের মোটরবাইকে বসিয়ে প্রতিদিন মাধ্যমিক পরীক্ষার কেন্দ্রে নিয়ে যাবেন, কথা দিয়েছিলেন অভিজিৎ। কিন্তু মাধ্যমিক পরীক্ষার ঠিক তিন দিন আগে তিনি নিজেই বাড়ি ফেরেন নিথর, কফিনবন্দি হয়ে!

Advertisement

২৮ নম্বর রাজপুত ব্যাটালিয়ানের জওয়ান অভিজিৎ মণ্ডল স্ত্রী অনিঞ্জিতা-র ফল দেখে যেতে পারেননি। গত ৭ মার্চ রাতে মণিপুরের চান্ডেল জেলায় খেংজোই ও বংজোই গ্রামের মাঝে টহলদার বাহিনীকে লক্ষ্য করে ৩টি আইইডি বিস্ফোরণ ঘটায় জঙ্গিরা। ঘটনাস্থলেই মারা যান নদিয়ার পলাশিপাড়ার পাঁচদাড়া গ্রামের তরুণ অভিজিৎ। ঠিক এক দিন পরেই বাড়ি ফেরার টিকিট কাটা হয়ে গিয়েছিল তাঁর। ঠিক করেছিলেন, স্ত্রী অনিঞ্জিতার পরীক্ষা যত দিন চলবে তত দিন সর্বাঙ্গপুরে শ্বশুরবাড়িতে স্ত্রী-র সঙ্গে থাকবেন, সাহস দেবেন।

কেউ কল্পনা করতে পারেননি ওই অবস্থায় অনিঞ্জিতা পরীক্ষা দিতে পারবেন। কাঁদতে-কাঁদতে ক্রমাগত সংজ্ঞা হারাচ্ছিলেন। কিন্তু তার মধ্যেও সবাইকে হতবাক করে দিয়ে রোগা, মুখচোরা মেয়ে বলেছিলেন, ‘‘পরীক্ষা দেব শুধু ওঁর জন্য।’’ অভিজিতের স্বপ্ন ছিল, অনিঞ্জিতা ভালভাবে মাধ্যমিক পাশ করবেন। অনেকদূর লেখাপড়া চালিয়ে যাবেন। স্বামীর শ্রাদ্ধও তখন হয়নি। তাঁর শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে পরীক্ষায় বসেছিলেন সদ্য স্বামীহারা অনিঞ্জিতা। তাঁর মনের জোরকে কুর্নিশ জানিয়েছিলেন পরিচিতেরা।

Advertisement

সেই মেয়েই এ বছর মাধ্যমিকে প্রথম চেষ্টাতে পাশ করেছে। এমন ভাগ্য বিপর্যয়ের সঙ্গে লড়াই করে পরীক্ষার চৌকাঠ একবারে পেরোতে পারবেন, এমন আশা কাছের মানুষেরা প্রায় কেউই করেননি। তাঁরা উচ্ছ্বসিত। শুধু মেঘ সরছে না অনিন্দিতার মনের। যে মানুষটি এ দিন সবচেয়ে খুশি হতেন তাঁকে আর কোনওদিনই কাছে পাবেন না।

সোমবার ভারাক্রান্ত গলায় অনিঞ্জিতা বললেন, ‘‘পাশ করেছি। কিন্তু রেজাল্ট ভাল হয়নি। মোট ২৭৩ পেয়েছি। সায়েন্স গ্রুপে নম্বর ভাল করতে পারিনি।’’ তার পর কিছুক্ষণ থেমে বলেন, ‘‘ভেবেছিলাম পরীক্ষা দেব না। এ ভাবে পরীক্ষা দেওয়া যায় না। কিন্তু ও বড় মুখ নিয়ে বলেছিল, পরীক্ষার সময় ছুটি নিয়ে এসে আমাকে সেন্টারে নিয়ে যাবে। আমাকে অনেক পড়াবে। ওর আশা পূরণ করতেই পরীক্ষা দিই।’’ নিজের স্কুল সবার্ঙ্গপুর জনকল্যান সংঘ আদর্শ বিদ্যাপীঠেই অনিঞ্জিতা উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হবেন।

প্রতিদিন তাঁকে পরীক্ষা কেন্দ্রে মোটর বাইকে করে নিয়ে যেতেন কাকা শুভেন্দু বিশ্বাস। তাঁর কথায়, ‘‘খুব কষ্টে পরীক্ষা দিয়েছে। মুখের দিকে তাকাতে পারতাম না। পাশ করবে ভাবতে পারিনি।’’ অনিঞ্জিতার বাবা সুলোচন বিশ্বাস ও মা অনিতা বিশ্বাসের এখন একটাই প্রার্থনা, জীবন যুদ্ধে যুঝতে থাকা তাঁদের মেয়েকে যেন আর নতুন করে কোনও ঝড়ের মুখে পড়তে না-হয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন