রানির মান ভাঙাতে বারোদোলের মেলা

রানির অভিমান বলে কথা! ইতিহাস বলে রাজমহিষীর মান ভাঙাতে নাকি আস্ত একটা মেলাই বসিয়েছিলেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়। জনশ্রুতি হল, নদিয়ারাজ তাঁর রানিদের বিশেষ করে দ্বিতীয়া পত্নীর মেলা দেখার ইচ্ছেপূরণের জন্য রাজবাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে এক মেলার আয়োজন করে ছিলেন।

Advertisement

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০১৭ ০৩:০৫
Share:

প্রণাম। কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য

রানির অভিমান বলে কথা! ইতিহাস বলে রাজমহিষীর মান ভাঙাতে নাকি আস্ত একটা মেলাই বসিয়েছিলেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়। জনশ্রুতি হল, নদিয়ারাজ তাঁর রানিদের বিশেষ করে দ্বিতীয়া পত্নীর মেলা দেখার ইচ্ছেপূরণের জন্য রাজবাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে এক মেলার আয়োজন করে ছিলেন। সেই পাটরানি একবার নদিয়ারাজের কাছে সেকালে বিখ্যাত উলার ‘জাতের মেলা’ দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাজকার্যের চাপে মহারাজ সে কথা বেমালুম ভুলে যান। তাছাড়া সেকালের আর্থ সামাজিক ব্যবস্থায় কোন রানির পক্ষে উলার মেলা দেখা শোভনীয়ও ছিল না। তাই মহিষীর আবদার রাখতে একটা আস্ত মেলা বসিয়ে ফেলেন রাজবাড়ির মাঠে। সেই মেলাই বারোদোলের মেলা।

Advertisement

যদিও ঠিক কবে থেকে কার আমলে বারোদোলের মেলা শুরু হয়েছিল তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কারও মতে, সুবিখ্যাত বারোদোলের মেলার প্রবর্তক মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র নন। কেননা রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র লিখিত অন্নদামঙ্গলে কৃষ্ণচন্দ্র সম্পর্কে অনেক কথা থাকলেও বারোদোলের কোন উল্লেখ নেই। অন্নদামঙ্গল রচিত হয় ১৭৫২ সালে। গবেষকদের অনুমান, ১৭৬৪ নাগাদ বারোদোলের মেলার সূচনা হয়েছিল। তাই ভারতচন্দ্রের কাব্যে তার কোন উল্লেখ নেই। বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার – নদিয়া, ১৯১০ সালের রিপোর্টে লিখেছিল, সে বারে বারোদোলের মেলায় ২০ হাজার মানুষের সমাগম হয়েছিল এবং মেলা রাজবাড়ির হলেও তাতে সাধারন মানুষই প্রধান ভূমিকা নিয়ে থাকেন।

ইতিহাস বলছে, নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র আনুমানিক ১৭৬৪ সাল নাগাদ বারোদোলের মেলা প্রবর্তন করেন। রং দোলের পর একমাত্র কৃষ্ণনগরেই রাধাকৃষ্ণের বারোদোলের মেলা অনুষ্ঠিত হয়। ‘হরিভক্তিবিলাস’ গ্রন্থে এই দোলের উল্লেখ পাওয়া যায়। বারোদোলের শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে “চৈত্রে মাসি সিতে পক্ষে দক্ষিণাভিমুখং হরিম, দোলারূঢ়ং সমভ্যরচ্য মাসমান্দোলয়েৎ কলৌ।” অর্থাৎ চৈত্রমাসের শুক্লা একাদশী তিথিতে দক্ষিণমুখ করে হরি বিগ্রহকে পূজার্চনা করে একমাস দোলনায় দোলাতে হয়।

Advertisement

শাস্ত্রজ্ঞ নদিয়ারাজ শাস্ত্র মেনেই সূচনা করেছিলেন বিরল এই বারোদোল উৎসবের। বারোটি বিগ্রহের দোল তাই বারোদোল। রাজবাড়ির পঙ্খের কাজ করা সুবিশাল ঠাকুর দালানের দক্ষিণদিকে চাঁদনী। সেখানেই বারোদোলের মূল মঞ্চ। নদিয়ারাজের কুলবিগ্রহ হল বড় নারায়ণ। বারোদোলে বড় নারায়ণের সঙ্গে আরও বারোটি কৃষ্ণবিগ্রহ থাকে। নামে বারোদোল হলেও সব মিলিয়ে মোট তেরোটি বিগ্রহ থাকত বারোদোলের উৎসবে। সেগুলি হল বলরাম, শ্রীগোপীমোহন, লক্ষীকান্ত, ছোট নারায়ণ, ব্রক্ষণ্যদেব, গড়ের গোপাল, অগ্রদ্বীপের গোপীনাথ, নদিয়া গোপাল, তেহট্টের কৃষ্ণরায়, কৃষ্ণচন্দ্র, শ্রী গোবিন্দদেব ও মদনগোপাল।

এইসব বিগ্রহের বেশির ভাগই কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর সুদীর্ঘ রাজত্ব কালে বিভিন্ন জায়গায় যেমন– বিরহী, বহিরগাছি, তেহট্ট, সুত্রাগড়, নবদ্বীপ বা শান্তিপুরে মন্দির নির্মাণ করে স্থাপন করেছিলেন। নদিয়ারাজ প্রদত্ত দেবোত্তর সম্পত্তিতে সারা বছর এইসব বিগ্রহের পূজার্চনা চলে আসছে সেই কৃষ্ণচন্দ্রের আমল থেকে। এক সময়ে বারোদোলের জন্য মহা সমারোহে বারোটি বিগ্রহকেই রাজবাড়ি আনা হতো। এখন অবশ্য সব বিগ্রহ রাজবাড়িতে আসে না। মূল উৎসব তিন দিনের। সেকালে প্রথম দিনে বিগ্রহদের রাজবেশে সাজানো হত মূল্যবান অলঙ্কার দিয়ে। দ্বিতীয় দিন ফুল বেশ। তৃতীয় দিন রাখাল বেশ।

বিধুভূষণ সেনগুপ্ত রচিত একটি কবিতায় বারোদোলের বিগ্রহগুলির একটি চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায়। “বিরহীর বলরাম, শ্রী গোপীমোহন/লক্ষীকান্ত বহিরগাছি গুরুর ভবন/নারায়নচন্দ্র ছোট ব্রহ্মণ্যদেব সহ/ আর বড় নারায়ণ রাজার বিগ্রহ/ গড়ের গোপাল পেয়ে স্থান শান্তিপুর/ অগ্রদ্বীপের গোপীনাথ স্থানে ঘোষঠাকুর/ নদিয়ার গোপাল তবে নবদ্বীপে স্থান/ ত্রিহট্টের কৃষ্ণরায় অগ্রে ফল পান/ অতঃপর কৃষ্ণচন্দ্র, গোবিন্দদেব আর/ উভয় বিগ্রহ স্থান আবাস রাজার/ মদনগোপাল শেষে বিরহীতে স্থিতি/ বারোদোলে তেরো দেব আবির্ভূত ইতি/ হেরিলে দেবেরে হরে আধি ব্যাধি ক্লেশ/ রাজবেশ ফুলবেশ রাখালের বেশ/ ভক্তিভরে দেবনাম করিলে কীর্তন/ সকল পাতক নাশে শান্তি লভে মন/ ইতি চৈত্র শুক্লপক্ষে শ্রীমন নদীয়াধীপস্য/ প্রাসাদোদ্যানে বারদোলাবির্ভূতনাং দেববিগ্রহানাং।”

এরপর জলঙ্গি দিয়ে বয়ে গিয়েছে অনেক জল। ফুরিয়েছে রাজ রাজড়ার কালও। কিন্তু বারোদোলের উৎসবে সবকিছু সেই আগের মতোই। নদিয়া রাজবাড়ির ছড়ানো নাটমন্দিরের পূর্বদিকের খিলানের নিচে পাশাপাশি রাখা হয়েছে বারোটি সুসজ্জিত কাঠের সিংহাসন। তার প্রতিটি আলো করে রয়েছেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে প্রতিষ্ঠিত নানা কৃষ্ণবিগ্রহ। ব্যতিক্রম কেবল একটি সিংহাসন। বারোদোলের প্রধান আকর্ষণ গোপীনাথকে গত কয়েক বছর থেকেই আসতে দেওয়া হচ্ছে না। কষ্টিপাথর গড়া মধ্যযুগের ভাস্কর্যের এক অতুলনীয় নিদর্শনের বদলে দ্বাদশতম সিংহাসনে ঠাঁই পেয়েছেন পটের গোপীনাথ।

কয়েক বছর ধরেই এ ছবি দেখতে ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে উঠছে মানুষের চোখ। এক সময়ে ভক্তের চোখে ছিল অকল্যাণের আশঙ্কা। অমঙ্গলের ভয়। গোপীনাথহীন মেলার ভবিষ্যত নিয়ে কপালে ভাঁজ পড়েছিল ব্যবসায়ীদের। কিন্তু এখন সে চোখে স্বজন হারানোর বেদনা। সকলে অনুভব করেছেন কুড়ি ইঞ্চি উচ্চতার সেই চেনা বিগ্রহকে আসতে দেওয়া না হলেও, বারোদোলের মেলায় তাঁর কৃপাদৃষ্টিকে ঠেকাতে পারা যায় নি। তাই তিনি সশরীরে না থেকেও যেন সর্বত্র রয়েছেন মেলা প্রাঙ্গণ জুড়ে। যদিও এই সময়কাল ধরে রাজপরিবারের উত্তরসূরিরা দিশাহারা হয়ে খুঁজে বেরিয়েছেন কী ভাবে ফিরিয়ে আনা যায় গোপীনাথকে। কিন্তু ক্রমশ হার না মানার প্রত্যয় বদলে গেছে হতাশায়। হার না মানার প্রত্যয়ী কন্ঠে সংশয়। গোপীনাথ ফেরাতে বারদোলের মেলায় তৈরি হয়েছিল নাগরিক মঞ্চ। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। গোপীনাথকে এখনো ফেরানো যায়নি। কিন্তু বারোদোল আছে বারোদোলেই। মেলা, নাগরদোলা, হরেক রকম পসরা সাজানো দোকান, আলোর রোশনাই আর মানুষের প্রবল উপস্থিতি সব মিলিয়ে বারোদোলের মেলা সেই আগের মতোই।

চৈতন্যদেবের নির্দেশে গোবিন্দ ঘোষ প্রতিষ্ঠিত অগ্রদ্বীপের গোপীনাথ নদিয়ার মানুষের বড় প্রিয়। তাঁর টানে আসা হাজার হাজার মানুষকে নিয়েই কয়েক শতাব্দী আগে কোনও এক চৈত্রে জমে উঠেছিল বারোদোলের মেলা। তারপর দিন যত গড়িয়েছে ততই লোকমুখে ছড়িয়েছে মেলার খ্যাতি। প্রাচীনত্ব এবং জনপ্রিয়তার বিচারে এ তল্লাটে বারোদোলের মেলার কোন জুড়ি নেই। এহেন বারোদোলের মেলায় গোপীনাথের না থাকার জন্য যে আশঙ্কার মেঘ জমতে পারত তা কেটে গিয়েছে প্রথম বছরেই। নদিয়ারাজ পরিবারের তরুণ প্রজন্মের মণীশচন্দ্র রায় বলেন, “কে বলেছে গোপীনাথ অনুপস্থিত? মেলার লাখো মানুষের ভিড়ে ভক্তরা তাঁদের প্রিয় দেবতাকে খুঁজে পেয়েছেন। তাঁর বিগ্রহ কেড়ে আটকে রাখা যায়, কিন্তু তাঁর অপার করুণা থেকে ভক্তকে বঞ্চিত করে কার সাধ্য?”

ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য

একই সুরে নদিয়া ডিস্ট্রিক্ট চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সম্পাদক গোকুলবিহারী সাহা বলেন, “বারোদোলের মেলা কিন্তু আর পাঁচটা মেলার মতো শুধু বাণিজ্যিক মেলা নয়। এর সঙ্গে গোটা বাংলাদেশের কয়েক’শো বছরের ইতিহাস জড়িয়ে আছে। এই মেলা এক সঙ্গে ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং অর্থনীতির ত্রিবেণী সঙ্গম। সুতরাং বারোদোলের মেলা যেমন চলছে তেমনই চলবে। এ বারেও একই রকম ভাবে মেলা হচ্ছে। কোনও অসুবিধা নেই। ব্যবসায়ীরা প্রতি বছরের মতো এবারও হাসি মুখেই বাড়ি ফিরবেন। তবে এখন বাইরে চৈত্র সেল চলছে। মানুষ তা নিয়ে ব্যস্ত। পয়লা বৈশাখ মিটে গেলেই কেনাকাটা বাড়বে।” বারোদোলের মেলা কৃষ্ণনগর সংলগ্ন এলাকার মানুষের কাছে মিলন মেলা হিসেবে পরিচিত শুরু থেকেই। সেকালের গ্রামীণ অর্থনীতিতে এই মেলার বিশেষ গুরুত্ব ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই গুরুত্ব বেড়েছে বই কমেনি। রাজবাড়ির চকের মাঠের বেশ কয়েক হাজার বর্গমিটার জুড়ে ছড়ানো মেলা প্রাঙ্গণ প্রায় মাসখানেক ধরে জমজমাট থাকে। মেলার বড় অংশ জুড়ে থাকে এক বাণিজ্যক সংস্থার বাজার। সেখানে বাংলাদেশ থেকে শুরু করে দেশের প্রায় সব ক’টি রাজ্যের হস্তশিল্পের বিকিকিনি চলে।তবে নোট বাতিলের জের কিছুটা হলেও যেন ছুঁয়ে আছে এবারের মেলাকে। এমনটাই বলছেন ব্যবসায়ীরা। এখনও তেমন কেনাকাটা শুরু হয়নি। তবে প্রচুর লোক আসছেন মেলায়। সন্ধ্যায় উপচে পড়ছে ভিড়।

নদিয়া রাজ কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর রাজত্ব কালে অনেক উৎসবের প্রচলন করেন। তার মধ্যে বারোদোলের মেলা অন্যতম। ধীরে ধীরে সে মেলা রাজার সঙ্গে প্রজার মিলনের সেতুবন্ধ হয়ে উঠল। প্রায় তিন শতাব্দী ধরে আড়ে-বহরে ক্রমশ বাড়তে থাকা বারোদোলের মেলার এটাই সবচেয়ে বড় সাফল্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন