রঘুনাথগঞ্জের এই সেই সিমেন্ট কারখানা। — নিজস্ব চিত্র।
মজুরি চুক্তি নিয়ে নেতৃত্বের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের আর্থিক বঞ্চনার অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের অন্দরে। বিরোধী দলের নেতারাও চুক্তিটিকে হাতিয়ার করে প্রচারে নেমেছেন। তাঁদের অভিযোগ, এই চুক্তির ফলে এ বার থেকে প্রতি মাসে প্রায় ৪০০ শ্রমিক সব মিলিয়ে অন্তত ২২ লক্ষ টাকা কম বেতন পাবেন।
সমস্যার কেন্দ্রে জঙ্গিপুরের দু’টি সিমেন্ট কারখানা। ফরাক্কা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র লাগোয়া সিমেন্ট কারখানায় প্রায় ৬০০ শ্রমিক কাজ করেন। আর রঘুনাথগঞ্জের ধলোর কাছে সাগরদিঘি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র লাগোয়া কারখানায় কাজ করেন প্রায় ৪০০ শ্রমিক। দু’টি কারখানারই উৎপাদন ক্ষমতা ১.৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন। ফরাক্কার কারখানায় কর্মরত শ্রমিকেরা সিটু ও কংগ্রেসের আইএনটিইউসি নিয়ন্ত্রিত শ্রমিক সংগঠনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন। সেখানে তৃণমূলের সংগঠন নেই।
গত বছর ৪ জুন ফরাক্কার কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দু’টি শ্রমিক সংগঠনের বেতন ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নিয়ে শ্রম দফতরের মউ চুক্তি হয়। সেই মতো, ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কোনও সংগঠনই দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করতে পারবে না। প্রতিটি অদক্ষ শ্রমিক প্রতি মাসে সরকার নির্দিষ্ট মজুরি-সহ বাড়তি ৪০ শতাংশ টাকা হাতে পাবেন। সেই সঙ্গে বিশেষ ভাতা ৩২৫ টাকা, বাড়তি বিশেষ ভাতা ১০৭৫ টাকা, সাফাই ও চিকিৎসা ভাতা ৫৫০ টাকা, বাড়ি ভাড়া ৯০০ টাকা, সর্ষের তেল বাবদ ৫০ টাকা, ৩ কিলোগ্রাম গুড় ও ছ’টি সাবান প্রাপ্য। গুড়, সাবান বাদে মাসে ২৬ দিনের মজুরি বাবদ ১২,১৮৪ টাকা হাতে পাবেন প্রত্যেক শ্রমিক। বছরে ২০ শতাংশ হারে কমবেশি প্রায় ২৯০০০ টাকা বোনাসও দেওয়া হবে।
গত ১১ জুন রঘুনাথগঞ্জের সিমেন্ট কারখানায় শ্রম দফতরের মধ্যস্থতায় মউ চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি-র নেতারা। সংগঠনের রাজ্য সভাপতি তথা তৃণমূল সাংসদ দোলা সেন তাতে স্বাক্ষর করেছেন। মুর্শিদাবাদ জেলার আইএনটিটিইউসি সভাপতি আবু সুফিয়ান, সংশ্লিষ্ট কারখানার তৃণমূল শ্রমিক সংগঠনের কার্যকরী সভাপতি সৈয়দ বদরে আলমেরও সই রয়েছে।
কী আছে ওই চুক্তিতে?
চুক্তিতে বলা হয়েছে: শ্রমিকেরা রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারি হারে (যেটি বেশি হবে) দৈনিক মজুরি পাবেন। আর কোনও আর্থিক সুবিধা নেই। বছরে বোনাস মিলবে তবে তা ৮.৩৩ শতাংশ হারে। এ ছাড়া, কারখানার মধ্যে ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসার সুবিধা পাবেন শ্রমিকেরা। সাধারণ ভাবে কাজের সময় ৮ ঘণ্টা হলেও এখানে শ্রমিকদের দৈনিক ৯ ঘণ্ট কাজ করতে হবে বলে চুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে।
কারখানার তরফে চুক্তিতে সই করেছেন যিনি, সেই পার্সোনেল ম্যানেজার সুমনকল্যাণ রায় বলেন, ‘‘চুক্তি মতো ১১ জুন থেকে দৈনিক ২৫৫ টাকা হারে (মাসে ২৬ দিন কর্মদিবস ধরলে) এক জন শ্রমিক মাসে মজুরি বাবদ ৬৬৩০ টাকা হাতে পাবেন। বোনাস প্রায় ৭০০০ টাকা।’’
দুই কারখানাতেই চুক্তি স্বাক্ষরের সময়ে উপস্থিত ছিলেন কলকাতার কেন্দ্রীয় সহকারী শ্রম কমিশনার ইউসি মিশ্র। দুই কারখানায় একই ধরনের কাজে মজুরির তারতম্য নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি তিনি। জেলা শ্রম দফতরের এক কমিশনার বলেন, ‘‘একই কাজে বেতনের বড় ফারাক হচ্ছে জেনেও তৃণমূলের নেতারা কেন ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে গেলেন, সেটাই বুঝতে পারছি না।’’
রঘুনাথগঞ্জের সিমেন্ট কারখানার ৪০০ শ্রমিক আইএনটিটিইউসি নেতাদের ভূমিকায় হতাশ। ক্ষুব্ধ শ্রমিকদের প্রশ্ন, শ্রমিকদের ভাতে মেরে কারখানার মালিককে এ ভাবে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার কারণ কী। তৃণমূলের এক নেতার কথায়, ‘‘চুক্তি সইয়ের আগে আট দিন ধরে দু’পক্ষের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। তার আগেই দলের নেতাদের হাতে ২৩ দফা দাবিপত্র তুলে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তার একটিও মানা হয়নি। তা সত্ত্বেও দলের শ্রমিক নেতারা সে চুক্তি কেন মেনে নিলেন, সেটাই রহস্যের।’’ চুক্তিতে স্বাক্ষরকারীদের অন্যতম, আইএনটিটিইউসি অনুমোদিত সংগঠনের কার্যকরী সভাপতি সৈয়দ বদরে আলমের বক্তব্য, ‘‘সংগঠনের তাবড় নেতারা চুক্তি নিয়ে আলোচনায় ছিলেন। তাঁরা যা বলেছেন সেই মতো সই করেছি।’’
জেলা তৃণমূলের-সহ সভাপতি সোমেন পান্ডে ফরাক্কায় বিভিন্ন শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত। তিনি বলেন, ‘‘ফরাক্কার অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখেই দাবিপত্র রচনা করে নেতাদের হাতে তুলে দিই। কিন্তু দল আমাকে শ্রমিক সংগঠনের কোনও কমিটিতেই রাখেনি। তাই আমি সেই আলোচনা থেকে সরে আসি।’’ তিনি বলেন, ‘‘মজুরি চুক্তি কার্যকরী করার ক্ষেত্রে ফরাক্কা আর রঘুনাথগঞ্জের মধ্যে জোন হিসেবে কোনও তফাত নেই। তাই সে দিক দিয়ে দু’টি কারখানার শ্রমিকদেরই একই হারে মজুরি পাওয়ার কথা। তবু চুক্তি মতো ফরাক্কার শ্রমিকদের চেয়ে রঘুনাথগঞ্জের শ্রমিকেরা প্রায় অর্ধেক বেতন পাবেন। কিন্তু দলের রাজ্য নেত্রী দোলা সেন সেই চুক্তিতে সই করছেন। তাই তা নিয়ে আমি কোনও মন্তব্য করব না।’’
তবে আইএনটিটিইউসির জেলা সভাপতি আবু সুফিয়ান বলেন, ‘‘২০১৮ সালের ১০ জুন পর্যন্ত এই চুক্তি বলবৎ থাকলেও ছ’মাস অন্তর রিভিউ করা হবে। তা ছাড়া কারখানা কর্তৃপক্ষ কিছু মৌখিক আশ্বাসও দিয়েছেন। ফরাক্কা বড় শিল্পশহর। তাই স্বাভাবিক ভাবেই শ্রমিকেরা বেশি মজুরি পান। তবে যদি দেখা যায় মজুরির ফারাকটা খুব বেশি হচ্ছে, শ্রমিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তা হলে আমরা শ্রম কমিশনারের দ্বারস্থ হব।’’
ফরাক্কার কংগ্রেস বিধায়ক মইনুল হক সেখানকার সিমেন্ট কারখানার শ্রমিক সংগঠনের সভাপতি। তিনি দাবি করেন, ‘‘এই চুক্তি শ্রমিক স্বার্থের বিরোধী। নিজেদের স্বার্থ না থাকলে কেউ এ ভাবে চুক্তি করতে পারেন না।’’ সিটুর জেলা সভাপতি আবুল হাসনাত খান ফরাক্কার বাসিন্দা। তিনি সর্বভারতীয় সিমেন্ট ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতিও। তাঁর বক্তব্য, ‘‘ফরাক্কার শ্রমিকদের অর্ধেক মজুরি পাবেন রঘুনাথগঞ্জের শ্রমিকেরা। এই চুক্তির পিছনে অন্য কোনও বোঝাপড়া আছে। তৃণমূলের নেতাদের এই বিশ্বাসঘাতকতার কথা তুলে ধরতে পথে নামছে সিটু।’’