ভাঙনে হারিয়েছে জলঙ্গির জৌলুস

এক সময়ে বড় বাজার হিসেবে জেলায় বেশ নামডাক ছিল জলঙ্গির। সারাদিনই গমগম করত বাজার। ব্যবসায়ীদের হাঁকডাক, ক্রেতাদের দর কষাকষি, ঘাটে মাঝিমাল্লাদের ভিড়, মালপত্রের ওঠানামা, কচিকাঁচাদের ছুটোছুটি—এ সবের মধ্যে দিয়ে কখন যে দিনের আলো রাতের আঁধারে বদলে যেত বোঝা যেত না।

Advertisement

সুজাউদ্দিন

জলঙ্গি শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০১৫ ০০:২৯
Share:

আগে যেখানে বাজার ছিল সেখানে এখন বইছে পদ্মা। ছবি: কল্লোল প্রামাণিক।

এক সময়ে বড় বাজার হিসেবে জেলায় বেশ নামডাক ছিল জলঙ্গির। সারাদিনই গমগম করত বাজার। ব্যবসায়ীদের হাঁকডাক, ক্রেতাদের দর কষাকষি, ঘাটে মাঝিমাল্লাদের ভিড়, মালপত্রের ওঠানামা, কচিকাঁচাদের ছুটোছুটি—এ সবের মধ্যে দিয়ে কখন যে দিনের আলো রাতের আঁধারে বদলে যেত বোঝা যেত না।

Advertisement

১৯৯৪ সালের পদ্মার ভাঙন বদলে দেয় সব কিছু। এলাকার স্কুল, অফিস, বাড়িঘর, দোকানপাট-সহ বহু কিছু তলিয়ে যায় পদ্মায়। বিলুপ্ত হয়ে যায় একটা জনপদ। বাড়িঘর হারিয়ে অনেকেই তখন বহরমপুর, করিমপুর বা ডোমকলে চলে যান। ধীরে ধীরে আর্থিক ভাবে পঙ্গু হয়ে পড়ে এক সময়ের মহকুমার সবচেয়ে বড় বাজার জলঙ্গি।

একটা সময় ভৈরবের পূর্ব পাড়ের এই জনপদ অর্থনৈতিক ভাবেও সমৃদ্ধ ছিল। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পদ্মা তখনও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেনি। বরং দিনের শেষে বিনোদনের জায়গা হয়ে উঠত পদ্মাপাড়। পদ্মাপাড়ে ছিল থানা, বিদ্যালয়, গ্রাম পঞ্চায়েত, বিএসএফের চৌকি ও বেশ কিছু সরকারি দফতর। জলঙ্গি বাজারে ডোমকল, রানিনগর, করিমপুর থেকেও ব্যবসায়ীরা আসতেন নিয়মিত।

Advertisement

কমবেশি ৭০০ ব্যবসায়ী চুটিয়ে ব্যবসা করতেন। পাট ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত জলঙ্গিতে ব্যবসার সম্ভাবনাকে খতিয়ে দেখতে এক সময় পদ্মার জলে বিশেষ বিমানও নেমেছিল। নয়ের দশকেও গমগম করত বাজার। বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষও নিত্যদিনের বাজার সারতেন এখান থেকেই।

ফলে খুব অল্প দিনের মধ্যে ফুলেফেঁপে উঠেছিল বাজার। বাজারের প্রবীণ ব্যবসায়ী কলিমুদ্দিন শেখের কথায়, ‘‘প্রতিটি দোকানেই দিনভর ভিড় লেগে থাকত। এলাকার তিন ফসলি জমিতে ভাল চাষও হত। ফলে পদ্মার মাছ আর ঘরের মোটা ধানের ভাত খেয়ে এলাকার মানুষ সুখেই ছিল।’’ তাঁর কথায়, ‘‘পদ্মাই বদলে দিয়েছে গোটা এলাকাকে। ভাঙনে সব শেষ হয়ে গেল আমাদের।’’

জলঙ্গির সেই সোনালি দিনের কথা শোনাচ্ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক তথা জলঙ্গি চোয়াপাড়ার বাসিন্দা শিশির সাহা। তিনি বলেন, ‘‘সীমান্ত লাগোয়া এই শহর থেকে কয়েকটি ছোট পত্রিকাও প্রকাশিত হত। বছরের নানা সময়ে যাত্রা থিয়েটার লেগেই থাকত।’’ তিনি জানান, ক্লাব বা অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে মণীষীদের জন্মদিন ছাড়াও স্মরণীয় দিনগুলিকে ঘিরে প্রায় অনুষ্ঠান লেগে থাকত। কখনও কলকাতা, কখনও স্থানীয় শিল্পীরাও যাত্রায় অভিনয় করতে আসতেন। দর্শক হিসেবে পুরুষ ছাড়াও মহিলাদের বড় একটা অংশের উপস্থিতি ছিল সেখানে। জেলার সবথেকে বড় এবং আদর্শ পরিবেশের স্কুলটিও গড়ে উঠেছিল এলাকার সাদিখাঁড়দেয়াড় গ্রামে।

পদ্মা পাড়ের এই গঞ্জ তখনও ছিল বাংলাদেশ থেকে আসা বর্ধিষ্ণু পরিবারের জনপদ। সাহিত্য, সংস্কৃতির রমরমা সেখান থেকেই জন্ম বলে মনে করেন অনেকে। সুস্থ সংস্কৃতির আমদানি হয়েছে ক্লাবে ক্লাবে। খেলাধুলাতেও সে সময় জলঙ্গি জেলা থেকে রাজ্যে, এমনকী দেশের মানচিত্রে নাম লিখিয়েছেন সুফিয়া, সহিদুল, সাইদুল ইসলাম ওরফে সেল্টুরা।

কিন্তু ১৯৯৪ সালে ভাঙনের পর অনেকেই জলঙ্গি ছেড়ে চলে যান। ভাটা পড়ে সাংস্কৃতিক কাজকর্মে। ৭০০ থেকে এখন ২৫০-এ ঠেকেছে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংখ্যা। লোকজনের আনাগোনা কমে গিয়েছে। বড় প্রতিষ্ঠানগুলিতেও আগের মতো সেই জৌলুস নেই।

ভাঙন রোধে বাঁধানো হয়েছে পাড়। পাড়েই তৈরি হয়েছে অতিথিনিবাস। কিছু দূরে তৈরি হয়েছে স্কুল। জোড়তলা এলাকায় ব্লক অফিসের পাশে হয়েছে থানা, সুদৃশ্য সভাকক্ষ। তবে বাজার আর তার পুরনো চেহারা ফিরে পায়নি। এক সময়ের গমগমে বাজার এখন অস্তিত্বের সঙ্কটে ধুঁকছে।

জলঙ্গি বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক আনোয়ার হোসেনের কথায়, ‘‘ভাঙন বদলে দিল সবকিছু। জমজমাট বাজারটি অল্প সময়ের মধ্যে মরা নদীর মতো শুকিয়ে গেল।’’ তাঁর অভিযোগ, ‘‘তবে জলঙ্গিকে উঠে দাড়াতে প্রশাসনও কোনও পদক্ষেপ করেনি।’’

তিনি জানান, এখনও পদ্মাকে ঘিরে এখানে একটা পযর্টনকেন্দ্র গড়া যায়। তাতে বাজারে লোকের আনাগোনাও বাড়বে। এলাকার মানুষের বিনোদনের একটা ব্যবস্থাও হবে। এছাড়াও সীমান্ত উন্নয়নের অর্থে আরও অনেক পরিকল্পনা নিয়ে এই বাজারকে আবারও পুরনো চেহারায় ফেরাতে পারত প্রশাসন। সে সব কিছুই হয়নি।

যদিও ডোমকলের মহকুমাশাসক পুষ্পেন্দু মিত্র বলেন, ‘‘ওই এলাকায় পদ্মাপাড়ে একটি অতিথি নিবাস হয়েছে। জোড়তলা এলাকায় একটি মোটেল তৈরি হচ্ছে। তা ছাড়াও বেশ কিছু প্রস্তাব আমরা জলঙ্গির জন্য পাঠিয়েছি। আশা করি তাতে কিছুটা হলেও পুরনো চেহারা ফিরবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন