দাম কই আমের, সঙ্কটে চাষিরা

নদিয়ার হিমসাগর আর ল্যাংড়ার কদর বাঙালির ঘরে ঘরে। ফি বছর জামাইষষ্টি থেকে শুরু করে গোটা গ্রীষ্মকাল জুড়েই আমের জোগান দিতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম অবস্থা হয় চাষিদের। লাভও হয়। কিন্তু এ বার চাষিরা এত কম আমের দাম পাচ্ছেন যে, আগামী বছর থেকে আমচাষ থেকে সরে আসার কথাও ভাবতে শুরু করেছেন অনেকেই। চাষিদের অভিযোগ, গোটা মরসুমে প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার আম কেনাবেচা হয় জেলায়। অথচ সেই আমের আলাদা ভাবে কোনও বাজার, বিপণন কিংবা সংরক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি।

Advertisement

সুস্মিত হালদার

কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০১৫ ০১:২৮
Share:

বাজারে আম প্রচুর। নেই শুধু ক্রেতা। কৃষ্ণনগরে সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।

নদিয়ার হিমসাগর আর ল্যাংড়ার কদর বাঙালির ঘরে ঘরে। ফি বছর জামাইষষ্টি থেকে শুরু করে গোটা গ্রীষ্মকাল জুড়েই আমের জোগান দিতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম অবস্থা হয় চাষিদের। লাভও হয়। কিন্তু এ বার চাষিরা এত কম আমের দাম পাচ্ছেন যে, আগামী বছর থেকে আমচাষ থেকে সরে আসার কথাও ভাবতে শুরু করেছেন অনেকেই।

Advertisement

চাষিদের অভিযোগ, গোটা মরসুমে প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার আম কেনাবেচা হয় জেলায়। অথচ সেই আমের আলাদা ভাবে কোনও বাজার, বিপণন কিংবা সংরক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। এ বছর নদিয়া জেলায় প্রায় ৫ হাজার ৪১১ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। যা গত বছরের তুলনায় প্রায় চারশো হেক্টর বেশি। সিংহভাগ বাগানেই হিমসাগর ও ল্যাংড়া আমের চাষ হয়। তবে জেলার উদ্যানপালন দফতরের উদ্যোগে সম্প্রতি আম্রপালি আমের চাষ বেড়েছে।

চাষিদের অভিযোগ, নদিয়ার বিখ্যাত হিমসাগর ও ল্যাংড়াকে দেশ বা বিদেশের বাজারে তুলে ধরা হয়নি। সে কথা মানতে নারাজ রাজ্যের কৃষি বিপণনমন্ত্রী অরূপ রায়। তিনি বলেন, ‘‘আমরা এই আমকে ‘প্রমোট’ করতে আম-লিচু উৎসব করেছি। দিল্লির হাটে হিমসাগর ও ল্যাংড়া আমকে তুলে ধরেছি। যাঁরা রফতানি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত আমরা তাঁদের সঙ্গে কথাও বলছি।’’ মন্ত্রী জানান, হিমসাগর ও ল্যাংড়া স্বাদে ও গন্ধে অন্য অনেক আমের থেকেই এগিয়ে। এই আম সংরক্ষণের জন্য স্থানীয় কৃষক বাজারে হিমঘর তৈরি করা হচ্ছে। সেটা হয়ে গেলেই এই সমস্যার অনেকটাই সমাধান হয়ে যাবে।

Advertisement

গত বছর জামাইষষ্টীর দিনে ভাল মানের হিমসাগর বিক্রি হয়েছিল ৩০ থেকে ৩৫ টাকা কেজি দরে। এ বার সেই আম বিক্রি হয়েছে ১২ থেকে ১৩ টাকায়। মাঝারি মানের হিমসাগর গত বার বিকিয়েছিল ২০ থেকে ২২ টাকা কেজি দরে। এ বার সেই আমে ৭ থেকে ৯ টাকার বেশি দাম পাচ্ছেন না চাষিরা। একই অবস্থা ল্যাংড়ার। গত বছর যেখানে এই আমের দাম ছিল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা প্রতি কেজি। এ বার সেই আমের দাম মাত্র ৩০ থেকে ৩২ টাকা।

জেলার অন্যতম বড় আমের বাজার মাজদিয়া। রাজ্য তো বটেই, বিহার, উত্তরপ্রদেশের মতো ভিন্‌ রাজ্যের পাইকাররাও ভিড় জমান এই বাজারে। আম ব্যবসায়ীরা জানান, বাজার খুব খারাপ হলেও মাজদিয়ায় প্রতিদিন কমপক্ষে ৪ থেকে ৫ কোটি টাকার ব্যবসা হয়। এই বাজারে প্রায় দু’শো জন আমের আড়তদার আছেন। তাঁদের একজন অমর সিংহ জানান, গত বারের তুলনায় চাষিরা এবার অর্ধেক দামও পাননি। এমন লোকসানের ফলে অনেকেই আমচাষ থেকে সরে আসতে চাইছেন। তাঁর আক্ষেপ, এত বড় একটা আমের বাজার। অথচ এখানে ন্যূনতম পরিকাঠামোও এখনও পর্যন্ত তৈরি হল না।

এ বার ৩৫ বিঘা জমিতে আমচাষ করেছেন শিবনিবাসের নৃপেন্দ্রনাথ শুকুল। নৃপেন্দ্রনাথবাবু জানান, আমের ব্যবসায় লাভ আছে বলে তিনি এতটা জমিতে আমচাষ করেছিলেন। কিন্তু এ বার সমস্ত হিসেব উল্টে গিয়েছে। ল্যাংড়া আমে কিছুটা দাম মিললেও হিমসাগরে ভাল লোকসান হয়েছে। শান্তিপুরের মনোজ প্রসাদ প্রায় ৫৭ লক্ষ টাকা দিয়ে চারটি বড় আমবাগান কিনেছেন। কিন্তু বাজারের যা অবস্থা তাতে তিনি ৩২ লক্ষ টাকাও ঘরে তুলতে পারবেন কিনা বুঝতে পারছেন না। মনোজবাবু বলছেন, ‘‘এতবড় ধাক্কা শেষ কবে খেয়েছি মনে পড়ছে না।’’

এমন হাল কেন? চাষিরা জানাচ্ছেন, এ বার সর্বত্রই আমের ভাল ফলন হয়েছে। বাজারে চাহিদার থেকে বেশি আম আমদানি হচ্ছে। জেলায় আম সংরক্ষণেরও কোনও ব্যবস্থা নেই। চাষিদের অভিযোগ, আর এই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে ফড়েরা। গাছ থেকে পাড়ার পরে ভাল দামের জন্যও আম তো আর মজুত করে রাখা যায় না। ফলে ফড়েরা যে দাম দেন সেই দামেই চাষিরা আম বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। ফড়েরা খুচরো বাজারে গিয়ে বেশি দামে আম বিক্রি করলেও চাষিরা কিন্তু বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছেন। চাষিদের দাবি, প্রতি বছরই ফলন বেশি বা কম হবে। সেটাই তো স্বাভাবিক। আর সেটা মাথায় রেখেই সরকারের উচিত আমের বিপণনের জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামো ও বাজার তৈরি করা। আমচাষি অমর সিংহ বলছেন, ‘‘আম সংরক্ষণের পাশাপাশি বাইরের দেশে রফতানির ব্যবস্থা না করতে পারলে চাষিরা কিন্তু আমচাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন‌।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন