নবদ্বীপে মনিপুর রাজবাড়িতে দোল উৎসব। ছবি সৌজন্য: উৎপল দাস।
মন কেমন করা পাহাড়ি সুরের ভেসে যাচ্ছে বসন্ত সন্ধ্যা। ‘শাবি লাও লাও, চৎসি লাও। কল্পকপা য়াম্মি, কনজাউবা য়াম্মি। মাংদাথারো লাও...’। মৈ-তৈ ভাষায় গাওয়া এই মণিপুরি লোকসঙ্গীতের তর্জমা করলে দাঁড়ায়, জ্যোৎস্নাময় বসন্ত রাতে শাবিকে তার প্রেমিক ডাকছে। আয় আয়, চল যাই। হিংসুটেরা দলে অনেক। ক্ষতি করার অনেকে আছে। শাবি তুমি আমার সামনে সামনে চলো। দাফফার উদ্দাম তালে হাতে হাত ধরে গোল হয়ে নাচছে কয়েকশো নানা বয়সের নারী-পুরুষ। ঘামে ভিজে যাচ্ছে সর্বাঙ্গ। গোলাপি আবিরে বদলে যাচ্ছে চাঁদের রঙ।
সকলের থেকে প্রিয়জনকে আলাদা করে পাওয়ার এই রাত, এই উৎসবের নাম থাবল চৌংবা। দোলের রাতে এ ভাবেই মেতে ওঠেন মণিপুরের আবালবৃদ্ধবনিতা। সুদূর মণিপুর থেকে বহুদূরে চৈতন্যধাম নবদ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে এক টুকরো মণিপুরেও সেই একই উৎসবের মাতন। মণিপুর রাজবাড়ির মূল ফটকের সামনের চত্বরে প্রায় দু’শো বছরের প্রাচীন বকুলগাছের নীচে প্রতি বছরই দোলের রাতে বসে থাবল চৌংবার আসর। মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত অনু মহাপ্রভু মন্দিরের সামনে মণিপুরের নিজস্ব ঘরানার দোলে সেই উৎসবে যোগ দিতে মণিপুরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাস-ট্রেন-বিমানে উড়ে আসেন কয়েক হাজার মানুষ। অনু মহাপ্রভু এবং নবদ্বীপ দুই-ই তাঁদের বড় প্রিয়।
এই ছবি যদি রাজবাড়ির বাইরের, তবে ভিতরের ছবি আরও রঙিন আরও নয়ন সুখকর। শতাব্দী প্রাচীন নাটমন্দিরে জমে উঠেছে নৃত্যগীতের আসর। বসন্ত রাগে গাওয়া পদাবলী কীর্তন, থাংতা নৃত্য, বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, চাক্ চানাবা এবং বসন্ত রাস—ফাল্গুনি একাদশী থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত পাঁচদিন ধরে বিশুদ্ধ মণিপুরি ঘরানায় এখানে পালিত হয় রাজবাড়ির বসন্তোৎসব। সেই ১৭৯৮ সালে মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র মণিপুর থেকে নবদ্বীপের এসেছিলেন। তার পর থেকে নবদ্বীপ এবং মণিপুরের মধ্যে গড়ে উঠছে এক আশ্চর্য সেতুবন্ধ। সেই পথেই অবিরাম চলাচল কয়েক শতাব্দী ধরে।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
শ্রীপঞ্চমীর দিন থেকেই মণিপুর রাজবাড়িতে বসন্ত উৎসব শুরু হয়ে যায়। ‘হরিভক্তি বিলাস’ গ্রন্থ অনুসরণে নিয়মনিষ্ঠার সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে পালিত হয় বিশেষ উৎসব। দোল পূর্ণিমা তিথিতে মহাপ্রভুর আবির্ভাব। তাঁর স্মরণে এখানে পোড়ানো হয় হয় ‘প্রভু’র আঁতুড়ঘর। মণিপুরের সেটাই ন্যাড়াপোড়া। দোল পূর্ণিমার সন্ধ্যায় তার পরেই শুরু হয় থাবল চৌংবা। জ্যোৎস্না রাতে সমবেত নৃত্য। একে মণিপুরের জাতীয় উৎসব বলা চলে। মণিপুরের নিজস্ব লোকগানের সুরে একজন ছেলে একজন মেয়ে এইভাবে পরপর দাঁড়িয়ে গোল হয়ে এই নাচে যোগ দেন। বাজে ‘পেনা’, বিশেষ ধরনের বেহালা। সঙ্গে ঢোলক, দাফফা আর মন্দিরা।
মণিপুর বিষয়ে বিশিষ্ট গবেষক প্রবীর ভট্টাচার্য বলেন, “ন্যাড়াপোড়া হয়ে গেল কচিকাঁচারা বাড়ি বাড়ি চাঁদা তুলতে বার হয়। এর নাম নাকা থেংবা। তা থেকে সংগৃহীত অর্থে পরদিন পালিত হয় চাক্ চানাবা বা বনভোজন। সকলের মধ্যে পারষ্পরিক সম্প্রীতি গড়ে তোলাই এই ধরনের প্রথার পিছনে লুকিয়ে থাকা কারণ।”
দোলের পর দিন হয় মণিপুর রাজবাড়ির দোল। পিচকারিতে রঙ ভরে আবির উড়িয়ে গৌরচন্দ্রিকা গাওয়া হয় ‘হোলি শানরি গৌরাঙ্গনা নদিয়াদা, নিত্যানন্দ গদাধর অদ্বৈতাগা লোয়ননা।’ যার অর্থ, গৌরাঙ্গদেব তাঁর পার্ষদদের নিয়ে নদিয়া নগরে হোলি খেলছেন।