খোকন আছেন স্টেশনে, নেই ভোটের খাতায়

কৃষ্ণনগর স্টেশনের ইলেট্রনিক ঘড়ির ঠিক নীচটায় শুয়ে আছেন বছর পঞ্চাশের মানুষটা। নোংরা পোশাক। একমুখ গোঁফদাড়ি। বোঝাই যায়, বহু দিন ব্লেডের ছোঁয়া পড়েনি। 

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৮ অগস্ট ২০১৯ ০৫:০৭
Share:

প্রতীকী ছবি।

ঘড়ির কাঁটায় রাত তখন প্রায় ৯টা।

Advertisement

কৃষ্ণনগর স্টেশনের ইলেট্রনিক ঘড়ির ঠিক নীচটায় শুয়ে আছেন বছর পঞ্চাশের মানুষটা। নোংরা পোশাক। একমুখ গোঁফদাড়ি। বোঝাই যায়, বহু দিন ব্লেডের ছোঁয়া পড়েনি।

মাথার নীচে একটা ছোট্ট কাপড়ের ব্যাগ। তাঁর সম্পত্তি। দু’বার ডাকতেই চোখ তুলে তাকালেন তিনি। নাম জানতে চাইতে কিছুক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থাকার পর বললেন— ‘খোকন’। ভোটার তালিকায় নাম আছে? ভোটার কার্ড? ভোট দিয়েছেন কোনও দিন? আধার কার্ড আছে? প্রশ্নগুলো শুনে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকেন তিনি। যেন প্রথম এ সব শুনছেন। তার পর ছোট্ট করে মাথা নাড়েন— ‘না’।

Advertisement

আশপাশে গুটিশুটি মেরে আরও কয়েক জন শুয়েছিলেন। প্রতি দিনই থাকেন। শুধু কৃষ্ণনগর নয়, নদিয়ার অন্য বড় বা মাঝারি স্টেশনে এঁদের দেখা মেলে। এঁদের চালচুলো নেই, মাথার উপরে ছাদ নেই। ঠিকানা নেই। ওঁদের আমরা ‘ভবঘুরে’ বলেই চিনি। কিন্তু এঁদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। আছেন সাধু-সন্ন্যাসী, বাউল-ফকিরও যাঁদের অনেকেরই ভোটার তালিকায় নাম নেই। নেই আধার কার্ডের মতো নাগরিকত্ব প্রমাণের ন্যূনতম নথি।

এঁদের বিপদটা কিন্তু মাথার উপরে ছাদ বা দু’মুঠো ভাতের প্রশ্নে সীমাবদ্ধ নেই। তার পরিধি অনেক বড়। যার কেন্দ্রে রয়েছে এ দেশে থাকতে পারা বা না-পারার মতো গুরুতর বিষয়ও। ভবিষ্যতে যদি এই রাজ্যেও অসমের মতো জাতীয় নাগরিকপঞ্জি বলবৎ করার চেষ্টা হয়, এই মানুষগুলোর কী হবে? ভোটার কার্ড বা আধার কার্ডের মতো পরিচয়পত্র যেখানে নেই, কী করে প্রমাণ করবেন তাঁরা এই দেশের নাগরিক, অনুপ্রবেশকারী নন?

এক দিকে এঁরা যেমন সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন, তেমনই সরকারি খাতার বাইরেও থেকে যান। সেই ফাঁক গলে ভবঘুরের ছদ্মবেশে কেউ যদি কোনও অপরাধ বা দেশবিরোধী কাজ করে চলে যায়, ধরা কঠিন। জেলার এক পুলিশকর্তার কথায়, “বিপদটা কিন্তু বড়। এই সব মানুষ যাঁদের ভোটার তালিকায় নাম নেই বা আধার কার্ডও নেই, তাঁদের আমরা খুঁজে পাব কী করে? যদি এঁদের মধ্যে কেউ অপরাধ সংঘটিত করে পালিয়ে যায়, তাকে তো চিহ্নিতই করা যাবে না!”

তবে উল্টো দিকের বিপদটাও কম না। সন্দেহের বশে পুলিশ যদি এঁদের কাউকে গ্রেফতার করে, জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্য বলে মামলা দিয়ে আদালতে চালান করে, এঁরা নিজেদের ভারতীয় নাগরিক বলেই প্রমাণ করতে পারবেন না, নিরপরাধ প্রমাণ হওয়া তো পরের কথা। জেলা প্রশাসনের এক কর্তার মতে, “সমস্যাটা দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসছে। এত দিন সকলে দেখেও দেখেনি। আবার দেখলেও তা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবেই দেখে এসেছে। রাণু মারিয়া মণ্ডলের ঘটনা এই প্রশ্ন সামনে এনে দিয়েছে। এখন যা এড়িয়ে যাওয়ার কোন উপায় নেই।”

কিন্তু চালচুলোহীন মানুষের জন্য ভোটার তালিকায় নাম তোলা বা আধার কার্ড তৈরির বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। তার পরেও তাঁরা পরিচিতির গণ্ডীর বাইরে কেন?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন