নদী খুঁড়ে জল নিচ্ছেন খড়গ্রামের বাসিন্দারা। —নিজস্ব চিত্র
রোদ্দুরের কী ঘুম নেই চোখে! বেলা আটটা বাজতে না বাজতেই তেতে পুড়ে মাটিতে হিজিবিজি ফাটল ধরেছে যেন। মরা মাঠ, হলদেটে ঘাস, আসশ্যাওড়ার ঝোপ পেরিয়েই মেরিনা বিবিদের রোজকার জল-যাত্রা। বলছেন, ‘‘আর পারি না গো, এই চল্লিশ ডিগগিরি সূজজি মাথায় করে জল আনতে গিয়ে হাঁফ ধরে যায়!’’ তাতেও তেষ্টা মেটে না। কাঁখে ঘড়া আর দু’হাতে খান দুই বালতি নিয়ে ঘরে ফিরতে না ফিরতেই জল সেষ। ‘‘মানুষের কী জলখাকি মুখ গো বাবা’’, গজগজ করছেন তিনি।
কিন্তু মেরিনা বিবির গ্রামের এ হাল কেন?
বছর খানেক আগে গ্রামের মোড়ে মোড়ে সজলধারা প্রকল্পে নলকূপ বসেছিল। তবে, ওই নলকূপ বসিয়েই দায় সেরেছে স্থানীয় পঞ্চায়েত। তা দেখভালের ব্যাপারে কর্তাদের কোনও হুঁশই নেই। খড়গ্রামের ধামালিপাড়া তাই এগারোটা ‘মরা-নলকূপ’ নিয়ে পড়ে রয়েছে। মেরিনাদের ভরসা এখন কানাময়ূরাক্ষীর বালি খুঁড়ে উঠে আসা খানিক ঘোলা জল। বালি-কাদা মেশানো সেই জল গামছায় থিতিয়ে গলা বেজাচ্ছেন তাঁরা।
খড়গ্রাম ব্লক কর্তারা জানাচ্ছেন, ১২টি পঞ্চায়েত এলাকায় হাজার দেড়েক নলকূপ। কিন্তু বেশির বাগই দেহ রেখেছে। খড়গ্রামের বালিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের ধামালিপাড়ায় হাজার চারেক মানুষের বাস। কানাময়ূরাক্ষীর একধারে খড়গ্রাম, অন্য দিকে পুরন্দরপুর। তেষ্টা মেটাতে ধামালিপাড়ার মানুষ মরা নদীর মাটি কোঁড়া জলেই বুক বেঁধেছেন।
ফুট দশেকের গর্ত খুঁড়ে সকাল-বিকেল গ্রামের লোক পানীয় জল খুঁজে চলেছেন। অভিযোগ, প্রতি বছরই গরমের সময় জলস্তর নেমে যায়। জলকষ্ট তখন তীব্র। এ বার জলস্তর তো নেমেইছে, তার উপর নলকূপগুলিও খারাপ হয়ে পড়ে রয়েছে। পঞ্চায়েতের টনক নড়ায় সাধ্য কার!
মেরিনা বিবি, জাহানারা বিবিরা বলছেন, ‘‘জল তুললেই হল, তাকে ছেঁকে তিতিয়ে তারপরে খেতে হবে। ধকল কম!’’ গ্রামের সম্পন্ন পরিবারগুলি অবশ্য জলকষ্ট থেকে নিষ্কৃতি পেতে বাড়িতেই বিদ্যুৎ চালিত পাম্পের বন্দোবস্ত করে ফেলেছে। কিন্তু সে তো হাতেগোনা কয়েকটা পরিবার। বাকিদের অবস্থা মেরিনাদের মতোই। গ্রামের আদম শেখ জানান, বার সাতেক পঞ্চায়েতে গিয়ে এ ব্যাপারে দরবার করা হয়েছে। কে শোনে কার কথা।
খড়গ্রাম পঞ্চায়েত সমিতির কৃষি কর্মাধ্যক্ষ কংগ্রেসের সুজিত ঘোষ। বলছেন, “২০১১ সালে আমি ওই পঞ্চায়েতের প্রধান ছিলাম। তখন সজলধারা প্রকল্পে নলকূপের ব্যবস্থা করেছিলাম। তা নলকূর খারাপ হয়ে গেলেও আমার দোষ?’’
খড়গ্রাম পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি কংগ্রেসের কানাইলাল ঘোষ অবশ্য দোষটা চাপাচ্ছেন প্রকৃতির উপরে— ‘‘আরে জলস্তর নেমে গিয়েছে। প্রকৃতির উপরে তো মানুষের হাত নেই!’’ অতএব ভরসা সেই কানাময়ূরাক্ষী, হারানো সেই নদীর দিকে তাকিয়ে মেরিনাদের জলযাত্রা চলছেই।