বাড়ি ফিরে রাঁধা হল না কাবেরীর

দু’দিন ধরে বাড়িতে নিরামিষ রান্না হয়েছে। বাড়ি থেকে বেরনোর সময় ছেলেমেয়েদের তিনি বলেছিলেন, ‘‘হাসপাতালের ডিউটি থেকে ফিরে আজ রাতে মাংস-ভাত। মাংসটা আজ যা রাঁধব না, দেখবি কেমন মুখে লেগে থাকবে।’’ সে কথা শুনে ছেলে খুশি হলেও মুখ ভার করে দাঁড়িয়েছিল ছোট মেয়ে।

Advertisement

শুভাশিস সৈয়দ

বহরমপুর শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০১৬ ০০:৫৪
Share:

শোকস্তব্ধ কাবেরীদেবীর পরিবার।— নিজস্ব চিত্র

দু’দিন ধরে বাড়িতে নিরামিষ রান্না হয়েছে। বাড়ি থেকে বেরনোর সময় ছেলেমেয়েদের তিনি বলেছিলেন, ‘‘হাসপাতালের ডিউটি থেকে ফিরে আজ রাতে মাংস-ভাত। মাংসটা আজ যা রাঁধব না, দেখবি কেমন মুখে লেগে থাকবে।’’

Advertisement

সে কথা শুনে ছেলে খুশি হলেও মুখ ভার করে দাঁড়িয়েছিল ছোট মেয়ে। মাকে জড়িয়ে সে নাগাড়ে বলে চলেছিল, ‘‘আজ আর তোমাকে হাসপাতালে যেতে হবে না। আমার সঙ্গে থাকো।’’ হাসতে হাসতে মেয়েকে কোলে তুলে তিনি বলেছিলেন, ‘‘তুই কি আজ আমাকে যেতে দিবি না? তাড়াতাড়ি ফিরে এসেই তো মাংস রাঁধব রে।’’

কিন্তু শনিবার দুপুরের মধ্যেই সব শেষ হয়ে গেল! মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় হাসপাতাল থেকে বেরোতে গিয়ে পদপিষ্ট হয়ে মারা যান কাবেরী সরকার ওরফে মামনি (৪০) নামে হাসপাতালের ওই আয়া। তাঁর বাড়ি বহরমপুরের সুন্দরকলোনি এলাকায়।

Advertisement

কাবেরীর স্বামী নির্মল সরকার পেশায় ভ্যানচালক। বড় ছেলে সোমনাথ দশম শ্রেণির ছাত্র। মেয়ে দিশা চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। স্বামী-স্ত্রী হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে সম্প্রতি বানজেটিয়ার সুন্দরকলোনি এলাকায় জমি কিনে একটি ছোট বাড়িও তৈরি করেছিলেন। গৃহপ্রবেশের কথা ছিল দিন কয়েক পরেই। কিন্ত তার আগেই এমন বিপত্তি।

গত পনেরো বছর ধরে হাসপাতালে আয়ার কাজ করছেন কাবেরী। প্রতিদিনের মতো এ দিনও বাড়িতে ছেলেমেয়েকে খাইয়ে তিনি হাসপাতালে এসেছিলেন সকাল আটটায়। অন্য আয়াদের সঙ্গে তিনি কাজ করছিলেন হাসপাতালের তিন তলায়। আগুনের খবর পেয়ে অন্য আয়াদের সঙ্গেই পড়িমড়ি করে তিনি সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন। সেই সময়েই তিনি হুমড়ি খেয়ে পড়ে যান। তাঁর উপর দিয়েই চলে যায় বেশ কয়েক জোড়া পা।

তাঁর সঙ্গীরাও ওই ভিড়ে আর কাবেরীকে খুঁজে পাননি। শেষতক তাঁরা কাবেরীর নিথর দেহ দেখতে পান হাসপাতালেরই একটি ঘরে। ওই ঘটনার পরেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন আয়ারা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে তাঁদের অভিযোগ, তিন তলার আপদকালীন দরজা খোলা থাকলে কিছুতেই এমন ঘটনা ঘটত না।

কাবেরীর সহকর্মী মৌসুমী পাণ্ডে বলেন, ‘‘আগুন লাগার কথা শুনে আমরা সকলেই প্রাণ বাঁচাতে হাসপাতালের বাইরে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছিলাম। আমাদের সঙ্গে মামনিও ছিল। যখন আগুন লেগেছে তখন ভিজিটিং আওয়ার্স চলছিল। ফলে ভিড়ও ছিল অনেক বেশি। সকলেই নিজেদের বাঁচাতে সংকীর্ণ সিঁড়ি দিয়ে নামার চেষ্টা করে। তখনই হাত ছেড়ে সিঁড়িতে মামনি পড়ে যায়।’’

মৌসুমীদেবী জানান, তাঁরা কয়েক জন মিলে চিৎকার করে তিন তলার একটা বন্ধ থাকা গেটের তালা খুলে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু নিরাপত্তরক্ষীরা চাবির হদিশই দিতে পারেননি। আয়াদের দাবি, ওই গেটের তালা খোলা থাকলে কাবেরীদেবীকে এ ভাবে মরতে হত না।

স্ত্রীর মৃত্যুর খবর পেয়ে হাসপাতালে ছেলেমেয়েকে নিয়ে ছুটে আসেন নির্মল। চারিদিকে ক্ষোভ-বিক্ষোভ-হইচই-ছোটাছুটির মধ্যে স্ত্রীর দেহের সামনে বসেছিলেন তিনি। ছেলেমেয়েকে জড়িয়ে ধরে তিনি বিড়বিড় করছিলেন, ‘‘এমন তো কথা ছিল না। ছেলেমেয়ে দু’টোকে আমি একা মানুষ করব কী ভাবে!’’

কাবেরীর পড়শি পারুল হাজরা বলছিলেন, ‘‘মেয়েটার কথা শুনে মামনি হাসপাতালে না গেলেই বোধহয় ভাল করত!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন