সিরিয়ালই উসকে দিচ্ছে যুগান্তরের কুসংস্কার?

চেতনা না এলে সূর্যদের দেহ ভাসবেই

কলার ভেলায় পরিপাটি বিছানায় যেন শুয়ে আছে সে। ভেসে চলেছে। পাশে খাবার, মাথার কাছে হ্যারিকেন। খুঁটি দিয়ে টাঙানো মশারিও। বারো বছরের সূর্য রায়ের মৃতদেহ এ ভাবে ভাসতে ভাসতে বুধবার দুপুরে ঠেকেছিল চন্দননগর রানির ঘাটে। গত রবিবার সাপের ছোবলে মৃত্যু হয়েছিল নদিয়ার কালীগঞ্জের কুলতলা ফরিদপুরের সূর্যর। 

Advertisement

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৮:১০
Share:

মনসার দয়ায় মৃতকে জীবিত করে ফিরিয়ে আনার কাহিনি নদীমাতৃক সর্পসঙ্কুল বাংলার ঘরে অমোঘ দৈববিধান হয়ে উঠেছিল। নিজস্ব চিত্র

কলার ভেলায় পরিপাটি বিছানায় যেন শুয়ে আছে সে। ভেসে চলেছে। পাশে খাবার, মাথার কাছে হ্যারিকেন। খুঁটি দিয়ে টাঙানো মশারিও। বারো বছরের সূর্য রায়ের মৃতদেহ এ ভাবে ভাসতে ভাসতে বুধবার দুপুরে ঠেকেছিল চন্দননগর রানির ঘাটে। গত রবিবার সাপের ছোবলে মৃত্যু হয়েছিল নদিয়ার কালীগঞ্জের কুলতলা ফরিদপুরের সূর্যর।

Advertisement

কেন সৎকার না-করে এ ভাবে কলার ভেলায় নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হল ওই বালকের দেহ, তার উত্তর খুঁজতে গেলে বেশ খানিকটা পিছিয়ে যেতে হবে। সময়টা মধ্যযুগ। মঙ্গলকাব্যে মজেছে বাংলা। চেনা লৌকিক দেবদেবী মঙ্গলকাব্যের হাত ধরে রাতারাতি কুলীন হয়ে উঠেছেন। প্রবল তাঁদের প্রতাপ। বিপুল ক্ষমতাবান সে সব দেবদেবী চটলে সর্বনাশ। ধনপতি কিংবা শ্রীমন্ত সওদাগরের মতো বিত্তবান বণিক এক মুহূর্তে ভিখারি হয়ে যান। আবার তাঁদের খুশি করতে পারলে কালনাগিনীর বিষে মৃত লখিন্দরও প্রাণ ফিরে পান। কবিকল্পনার মনসা, শীতলা, চণ্ডী, ধর্মঠাকুরকে ঘিরে ক্রমশ মানুষ মধ্যে বিশ্বাস জন্মাতে শুরু করে। মঙ্গলকাব্যে মৃত স্বামীর দেহ নিয়ে বেহুলার ঘোষণা, “আমার বচন শুন কেহ না করিও আন, শুনহ শ্বশুর সদাগর। নিশ্চয় কহিলাম দৃঢ় কলার মান্দাস গড়, জিয়াইব কান্ত লখিন্দর।” তার পর গাঙ্গুরের জলে ভেলায় মৃত স্বামীকে নিয়ে ভেসে পড়া এবং শেষ পর্যন্ত জীবিত ফিরিয়ে আনার কাহিনি নদীমাতৃক সর্পসঙ্কুল বাংলার ঘরে-ঘরে অমোঘ দৈব বিধান হয়ে উঠল। মনসার মাহাত্ম্যের ভরসায় ওঝা-গুনিনের দল ফুলে ফেঁপে উঠল। আর গঙ্গা-জলঙ্গি- ভৈরব-মাথাভাঙ্গা-চূর্ণীর বুকে সারি সারি ভাসতে লাগল কলার মান্দাস। মৃত লখিন্দরদের শব।

এর পর গাঙ্গুর, গঙ্গা দিয়ে বয়ে গিয়েছে অনেক জল। সময় বদলেছে। সাপের ছোবলে মৃতপ্রায় রোগী বাঁচানোর মতো ওষুধ নাগালের মধ্যে এসেছে মানুষের। কিন্তু কয়েক শতাব্দী এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম মনের ভিতর বয়ে আনা কুসংস্কারের শেকড় উপরে ফেলা যায়নি। “কি করে যাবে? আমাদের ‘এলিট’ বিজ্ঞান সংস্কৃতি যতদিন না জনমুখী বিজ্ঞাচর্চ্চায় বদলানো যাবে তত দিন এ জিনিস চলবে। এক দল শিক্ষিত মানুষ বিজ্ঞান নিয়ে আর এক দল শিক্ষিত মানুষের সামনে সচেতনতার কথা বললে কুসংস্কার বদলায় না।” ক্ষোভের সঙ্গে বলেন চাকদহ বিজ্ঞান মঞ্চ ও সাংস্কৃতিক সংস্থার সম্পাদক বিবর্তন ভট্টাচার্য। তার মতে, ‘‘যে সব ধারণা কয়েক শো বছর ধরে তিলে তিলে মানুষের মনে গেঁথে দেওয়া হয়েছে তাকে ওপড়াতে গেলে চাই ধারাবাহিক আন্দোলন। অন্যদিকে গ্রামে, ব্লকে, হাসপাতালে পর্যাপ্ত ‘অ্যান্টিভেনামের’ যোগান থাকতে হবে। তিনি বলেন, “আমাদের দুর্ভাগ্য। এখনও একটা বড় অংশের মানুষের মনে আমরা আলো দিতে পারিনি। শহুরে মানুষ নয়, সূর্যের বাবার মতো প্রত্যন্ত গ্রামের গৃহস্থদের, কলার ভেলায় ভাসানোর নিদান দেওয়া ওঝাদের ক্রমাগত সচেতন করতে হবে।’’

Advertisement

যুক্তিবাদী সংগঠনের কর্মীরাই আফশোসের সুরে জানালেন, এখনও ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’ বা ‘নাগিনার’ মতো সিনেমা রমরমিয়ে চলে। বাংলা-হিন্দিতে সর্পদেবতা বা মনসাকে নিয়ে একাধিক সিরিয়াল টিভিতে দাপিয়ে চলে। এর পাল্টা সচেতনতা আন্দোলন গড়ে উঠলে কালীগঞ্জে অনতিদূরে খেদাইতলার মনসা মেলায় আলো ঝলমলে মঞ্চে গাওয়া হতেই থাকবে, “নানারূপ বন্ধ করি বাঁশের গজাল মারি, সাজাইল কলার মান্দাসে। বেহুলা ভাসিল জলে মরা পতি লয়ে কোলে, নিবেদন শ্রীকেতকা দাসে।” আর কলার ভেলায় ভাসতে থাকবে সূর্যদের দেহ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন