প্লাস্টিকের সঙ্গে যুঝতে মঞ্চের প্রস্তাব

শহরকে প্লাস্টিকমুক্ত করা হোক

নবদ্বীপের বয়স হাজার বছরেরও বেশি। ইতিহাসের ধুলো ঘেঁটে যত দূর জানা গিয়েছে এই শহরের পত্তন হয়েছিল ইংরেজি ১০৬০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ। সেনরাজা বল্লাল সেন ও লক্ষ্মণ সেনের (১১৫৯ – ১২০৬ খ্রিঃ) রাজত্বে নবদ্বীপ ছিল অখণ্ডিত বাংলার রাজধানী। কালের নিয়মেই এল মধ্যযুগ। সংস্কৃত ভাষাচর্চা, নব্য ন্যায়ের আলোকে অক্সফোর্ড অফ বেঙ্গল হয়ে ওঠার দিকে ইতিহাসের পথ বেয়ে নবদ্বীপের যাত্রা শুরু হল।

Advertisement

নবদ্বীপ

শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০১৫ ০১:৫৪
Share:

নবদ্বীপে পরিক্রমা। ফাইল চিত্র।

নবদ্বীপের বয়স হাজার বছরেরও বেশি। ইতিহাসের ধুলো ঘেঁটে যত দূর জানা গিয়েছে এই শহরের পত্তন হয়েছিল ইংরেজি ১০৬০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ। সেনরাজা বল্লাল সেন ও লক্ষ্মণ সেনের (১১৫৯ – ১২০৬ খ্রিঃ) রাজত্বে নবদ্বীপ ছিল অখণ্ডিত বাংলার রাজধানী। কালের নিয়মেই এল মধ্যযুগ। সংস্কৃত ভাষাচর্চা, নব্য ন্যায়ের আলোকে অক্সফোর্ড অফ বেঙ্গল হয়ে ওঠার দিকে ইতিহাসের পথ বেয়ে নবদ্বীপের যাত্রা শুরু হল। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জ্ঞানপিপাসু মানুষের ঢল নামল। ১৪৮৬ তে নবদ্বীপে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবের পর থেকে দেশের মানুষের আধ্যাত্মিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, নৈতিক চেতনায় জোয়ার এল। নবদ্বীপ হয়ে উঠল ভারতের জাতীয় মানচিত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ নগর। স্বাভবিক ভাবেই জনবিন্যাসে বদল ঘটতে শুরু করল নগর নবদ্বীপের।
ভৌগলিক দিক থেকে নবদ্বীপের অবস্থান অনেকটা তাওয়ার মতো। ষোড়শ শতাব্দীর আগে গঙ্গা নবদ্বীপের পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত হত। এখন যা পূর্ব দিকে সরে গিয়েছে। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে ওপার বাংলা থেকে হাজার হাজার শরণার্থী আশ্রয় নিল শ্রীমন মহাপ্রভুর পদরেণুধন্য নবদ্বীপে। যে যেখানে জায়গা পেল যেমন খুশি আস্তনা গড়ে নিল কোনও পরিকল্পনা ছাড়াই। ঘনবসতি পূর্ণ একটি শহরের নিকাশি ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল। ফলে প্রতি বর্ষায় গঙ্গার জল বাড়লেই প্লাবিত হওয়া নবদ্বীপের সাধারণ ভবিতব্য হয়ে দাঁড়াল। শহরের দীর্ঘ দিনের বাসিন্দা এবং একজন বরিষ্ঠ নাগরিক হিসেবে এই শহরের ১৯৫৬, ৫৯, ৭১, ৭৮, ৮৭, ৯৯, ২০০০ এবং ২০০৬ সালের বন্যা দেখেছি। এরমধ্যে ২০০০ সালের বন্যা ছিল প্রলয়ঙ্করী। ভূগোলের ছাত্র হিসেবে অনুসন্ধান করে যেটুকু বুঝেছি ২০০০ সালের বন্যা আক্ষরিক অর্থেই ছিল ‘ম্যান মেড’। তথাকথিত শিক্ষিত মানুষের অপরিণামদর্শীতা এবং নির্লজ্জ লোভের পরিণাম। সে বারে বৃষ্টির পরিমাণ প্রচুর হওয়ায় আমরা সামলাতে পারিনি ক্ষুব্ধ প্রকৃতির ক্রোধ।

Advertisement

এ বারের বৃষ্টিতে আমার ভিন রাজ্যবাসী ছোট নাতি নবদ্বীপে বেড়াতে এসে একটি সরল প্রশ্ন করেছিল। যার উত্তর আমিও দিতে পারিনি। সে জানতে চেয়েছিল, ‘‘দাদাভাই এখানে চারদিকে শুধু প্লাস্টিক কেন? যারা ফেলে তাদের কেউ বকে না? আমাদের স্কুলে যে এমন করবে, তার সঙ্গে আমরা কেউ কথাই বলব না।” সর্বত্র পলিথিন, প্লাস্টিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার এবং তার জেরে উদ্ভূত পরিস্থিতিই বর্তমান নবদ্বীপ শহরের অন্যতম প্রধান সমস্যা বলে চিহ্নিত হওয়া উচিত। বৃষ্টি হলেই শহরের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলিতে জল জমা এ শহরের বহু পুরানো ব্যাধি। কবে আমরা এর থেকে মুক্ত হব? নবদ্বীপে আজ পর্যন্ত কোনও আধুনিক নিকাশি ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। উল্টে প্লাস্টিকে ছয়লাপ শহরের ছোটবড় প্রতিটি নিকাশি নালার মুখ আজ রুদ্ধ। প্লাস্টিকে যেহেতু পলিমার, স্টাইরিন, ভিনাইল, ক্লোরাইড থাকে বিপজ্জনক মাত্রায়। তাই ক্যানসার, হাঁপানি, রক্তসংক্রান্ত রোগ, চর্মরোগ আমাদের নিত্যসঙ্গী। যে সব পলিব্যাগ আমরা দু’বেলা ব্যবহার করতে বাধ্য হই সেগুলি সবই জৈব অবিশ্লেষ্য প্রকৃতির। এ গুলোই ড্রেনে পড়ে এত্তা জঞ্জাল ছড়াচ্ছে আমাদের প্রিয় শহরে। কখনও কখনও শহর হয়ে উঠছে জীবন্ত নরককুণ্ড। সরকার, স্থানীয় প্রশাসন এই বিষয়ে আশু পদক্ষেপ করুক। গণচেতনা বাড়ানোর জন্য স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং শহরের সর্বস্তরের মানুষকে এর বিষময় ফলের বিষয়ে অবহিত করার জন্য একটা যৌথমঞ্চ গড়া দরকার।

অশোকগোবিন্দ চৌধুরি, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, বোসপাড়া

Advertisement

পঞ্চক্রোশী পরিক্রমা

পঞ্চক্রোশী পরিক্রমা অর্থাৎ পাঁচ ক্রোশ। যা কিনা শ্রীবৃন্দাবনের প্রতি একাদশী, পূর্ণিমা এবং বিভিন্ন তিথিতে দলে দলে ভক্তগণ যমুনাকে বাঁ দিকে রেখে সমগ্র বৃন্দাবনকে পরিক্রমা করেন। নবদ্বীপেও পঞ্চক্রোশী পরিক্রমা হয় না এমন নয়। কিন্তু সামান্য মাত্রায় কয়েকটি বিশেষ উৎসবে বিভিন্ন মঠ-মন্দিরের কিছু ভক্ত বৈষ্ণবগণ পরিক্রমা করে থাকেন। আর দোলপূর্ণিমার সময় প্রায় পনেরো দিন ধরে গৌরলীলা স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলির মাধ্যমে নয়-দ্বীপ পরিক্রমার সময়ে পঞ্চক্রোশী দিয়ে থাকেন বহু ভক্ত। কিন্তু সারা বছর ধরে স্বল্প সংখ্যক বৈষ্ণব ভক্ত আলাদা করে পঞ্চক্রোশী দেন। কিন্তু সেই পথ মাঝে মাঝেই খারাপ। খালি পায়ে হেঁটে পরিক্রমা করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। কোনও কোনও রাস্তায় নেই ঠিক মতো আলো। সন্ধ্যে নেমে আসলেই অন্ধকারে পথ দেখা যায় না।

তাই আমি গৌড়ীয় বৈষ্ণবসমাজের প্রতিনিধি হিসাবে আলোকপাত করতে চাই যে পরিক্রমা মার্গ প্রায় প্রস্তুত। তার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন শুধু সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু শুধু দিক নির্দেশই শেষ কথা নয়। তার সুন্দর পরিকাঠামো দরকার। সমগ্র পরিক্রমা মার্গের সুন্দর আলো, সুন্দর রাস্তা যা কিনা খালি পায়ে হেঁটে যাওয়ার পক্ষে উপযুক্ত। পথে দরকার পানীয় জলের ব্যবস্থা অর্থাৎ বিশেষ বিশেষ জায়গায় জলসত্র। কারন আনুমানিক পনেরো কিলোমিটার পথ পরিক্রমা করতে তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় লাগে। তার জন্য বেশ কিছু স্থানে বিশ্রামের ব্যবস্থা এবং বিনামূল্যে রাত্রিবাসের সুব্যবস্থা-সহ উপযুক্ত পরিকাঠামো দরকার যা উৎসাহিত করবে দূরদুরান্ত থেকে আসা অসংখ্য বৈষ্ণব ভক্তদের। দেশ-বিদেশের অনুরাগী গৌরপ্রিয় মানুষ পঞ্চক্রোশী পরিক্রমা করবেন যার ফলে শ্রীধাম নবদ্বীপ হয়ে উঠবে এক আনন্দমুখর ভগবতীয় পীঠস্থান। একদিকে যেমন ভক্তজন আনন্দলাভ করবেন অন্য দিকে শহরের বণিকমহল এত মানুষের সমাগমে লাভবান হবেন এবং শ্রীধাম নবদ্বীপের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে।

ভাগবতকিশোর গোস্বামী, শ্রীশ্রী রাধা সুদর্শনলাল জিউ মন্দির

সংস্কার জরুরি

হাজার বছরের ধারাকে বয়ে নিয়ে আসা শহর শ্রীধাম নবদ্বীপ। চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পর সারা বিশ্বকে যে শহর নতুন পথের দিশা দেখায়। সেই গর্বে গর্বিত শহর বারবার গঙ্গার ভাঙনে তছনছ হয়েছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শহরের উত্তর দিক। যা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বহু লীলাগাথার সাক্ষী। তুলনায় শহরের দক্ষিণ দিকটি অনেকটাই অক্ষত, যা কিনা নবদ্বীপের প্রাচীন সংস্কৃতির ধারাকে বহন করে। নবদ্বীপের মূল অর্থনীতি বর্তমানে পর্যটক নির্ভর। একদিকে আধ্যাত্মিকতা, অন্য দিকে অধ্যাত্মিকতার উপর ভিত্তি করে অর্থনীতিতে সম্পূর্ণ এবং সমৃদ্ধ হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে নবদ্বীপ। সেই চেষ্টা সম্প্রতি নদিয়া-মুর্শিদাবাদের পাতায় ‘আমার শহর’ বিভাগে নবদ্বীপে পঞ্চক্রোশী পরিক্রমার খবর হয়ে উঠে এসেছে। নবদ্বীপবাসীর কাছে এ এক অত্যন্ত সুখকর অভিজ্ঞতা। যদি ঠিক পথে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজ এবং বিভিন্ন আধ্যাত্মিক সংগঠন এগিয়ে আসে, তাহলে কালে কালে তা আরও সুন্দর হয়ে উঠবে।

নবদ্বীপ পণ্ডিতসমৃদ্ধ স্থান বলে শুধু থেমে থাকলে হবে না। নবদ্বীপের পণ্ডিত সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট হল এখানে বংশপরম্পরায় পাণ্ডিত্যের ধারা বয়ে চলে। একদা ‘অক্সফোর্ড অফ বেঙ্গলের’ প্রাতঃস্মরণীয় পণ্ডিতদের বংশধরেরা আজও রয়েছেন এই শহরে। তাঁরাই বয়ে নিয়ে চলেছেন সুপ্রাচীন সেই ঐতিহ্যকে। সেই সব নক্ষত্রদের গৃহগুলি, প্রাচীন গোস্বামী বাড়িগুলিকে চিহ্নিতকরণ খুব জরুরি। কেননা আধুনিকতা আবার প্রাচীনত্বকে পছন্দ করে না। নতুন তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ময়কর প্রভাব ভুলিয়ে দিতে চায় আমাদের শিকড়টিকে। প্রাচীনকে সংরক্ষণ করে নতুনকে আবাহন করতে হবে। তার জন্য চাই সচেষ্ট প্রয়াস।

নবদ্বীপের হারিয়ে যাচ্ছে এমন কিছু আখড়া বাড়ি, পুরানো নাটমন্দির যেগুলি ৩৫০ থেকে ৪০০ বছরের পুরনো। যেখানে একদা বছরে প্রায় ২০০ দিন নানা অনুষ্ঠান হত। যাত্রাগান, কথকতা, পালা কীর্তন কিংবা আধ্যাত্মিক কথোপকথন হত। আবার কবে হবে কোলাহল, কবে হবে বৈঠক! তার জন্য হারিয়ে যেতে বসা চণ্ডীমণ্ডপ, ক্ষয়ে যেতে বসা দালান, মন্দির প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে। সেগুলিকে সামগ্রিক ভাবে সংস্কারের প্রয়োজন। তা না হলে নবদ্বীপের ইতিহাস বারবার ধাক্কা খাবে। কৌলিন্যবর্জিত আধুনিক আধ্যাত্মিক নগরী সৃষ্টির কারণে অসংখ্য মন্দির ঘেরা নবদ্বীপ অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধ না হওয়ায় কোথায় যেন একটা শূন্যতা থেকেই যাচ্ছে। সকলের সামগ্রিক প্রচেষ্টায় নবদ্বীপ যেন সেই ৫২৯ বছর আগের শ্রীচৈতন্য জন্মভূমির গৌরবান্বিত শ্রীধাম নবদ্বীপ হয়ে ওঠে।

কিশোরকৃষ্ণ গোস্বামী, শ্রীশ্রী বলদেব জিউ মন্দির, গানতলা রোড

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন