সেতু নেই। গাড়ি পার করতে নৌকোই ভরসা। —নিজস্ব চিত্র।
দু’টো পাড় এক হতে চায়। এবং সেতুরও প্রয়োজন আছে। কিন্তু মহকুমায় উন্নীত হওয়ার উনিশ বছর পরেও তেহট্টে জলঙ্গি নদীর উপরে সেতু তৈরি হল না!
১৯৯৬ সালের ৮ জানুয়ারি তেহট্টকে মহকুমা ঘোষণা করা হয়। কিন্তু খোদ মহকুমা সদর তেহট্টে নেই-এর তালিকাটা নেহাত ছোট নয়। তেহট্টের পাশ দিয়ে বয়ে চলা জলঙ্গির উপর একটি সেতুর দাবি দীর্ঘ দিনের। কিন্তু সেই দাবি আজও পূর্ণ হয়নি। এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, নির্বাচনের আগে অনেক প্রতিশ্রুতির মধ্যে সেতুর বিষয়টি একবার ওঠে। আর মাঝেমধ্যে সেতু তৈরি হবে বলে নদীর পাড়ে কিছু লোকজন মাপজোক করেন। ব্যস, প্রাপ্তি বলতে ওইটুকুই!
মহকুমা সদরে রয়েছে স্কুল, আদালত, হাসপাতাল-সহ গুরুত্বপূর্ণ অফিস। তেহট্ট ২ ব্লকের মোট সাতটি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ছয়টি গ্রাম পঞ্চায়েতই জলঙ্গির পশ্চিম পাড়ে। নানা কাজ নিয়ে দৈনিক ওই এলাকার মানুষকে নদী পেরিয়ে আসতে হয় তেহট্টে। ওই এলাকাগুলো তেহট্ট থানার অন্তর্গত হওয়ায় শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে গিয়েও সমস্যায় পড়তে হয় পুলিশ ও মহকুমা প্রশাসনকে।
নদীর পশ্চিম পাড়ের গ্রাম হাঁসপুকুরিয়ার বাসিন্দা, পেশায় আইনজীবী মৃন্ময় দত্ত বলেন, “খুব ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে বাজার করতে তেহট্টে আসতাম। তখনও বর্ষাকালে নৌকো আর অন্য সময়ে বাঁশের সাঁকো দিয়ে নদী পার হতাম। আজ প্রায় ত্রিশ বছর পরেও ছবিটা বিশেষ বদলায়নি। এটা ভাবতেও যেমন কষ্ট হয়, তেমনি লজ্জাও করে।’’ তাঁর আক্ষেপ, মহকুমার বয়স আজ প্রায় কুড়ি বছর হতে চলল। কিছু সরকারি ভবন তৈরি হয়েছে। কিন্ত সেতু নিয়ে কারও কোনও ভাবনাচিন্তা আছে বলে মনে হয় না। অথচ দু’টো পাড়ের বাসিন্দারা চান শীঘ্র এই সেতুটি হোক। জলঙ্গির উপর এই সেতুটি হয়ে গেলে তেহট্টের আর্থ-সামাজিক চেহারাটা বদলে যেত।
জেলা পুলিশের এক কর্তা জানান, সম্প্রতি তেহট্ট থানাকে ভেঙে পলাশীপাড়া থানা তৈরির প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। তবে সেতু তৈরি হলে পুলিশ তো বটেই, ওই দুই পাড়ের বাসিন্দাদেরও সুবিধা হবে। এখন নদীর পশ্চিম পাড়ে দুই কিলোমিটার দূরের কোনও এলাকায় যেতে হলে প্রায় বিশ কিলোমিটার রাস্তা ঘুরে যেতে হয়। সেতু থাকলে সেখানে পৌঁছে যাওয়া যাবে পাঁচ মিনিটেই। সেক্ষেত্রে সময় ও অর্থ দুই-ই বাঁচত। নতিপোতার বাসিন্দা পীযূষ মণ্ডল জানান, তেহট্ট ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র মহকুমা হাসপাতালে উন্নীত হয়েছে। পরিষেবাও আগের থেকে বেড়েছে। কিন্তু জলঙ্গি নদীর পশ্চিম পাড়ের মানুষের তাতে কোনও উপকার হয়নি। কেন?
পীযূষবাবু বলেন, ‘‘আমাদেরও নিকটতম হাসপাতাল তেহট্ট মহকুমা হাসপাতাল। কোনও রোগীকে সেখানে নিয়ে যেতে হলে ওই বাঁশের সাঁকো উপর দিয়েই নিয়ে যেতে হয়। বর্ষাকালে রিকশা কিংবা গাড়ি নৌকার উপরে তুলে পার হতে হয়। দিনের বেলা হলে তবুও রক্ষে, কিন্তু রাত হয়ে গেলে সমস্যা আরও বেড়ে যায়। বছরের পর বছর ধরে এমনটাই চলছে। সব জেনেও টনক নড়ে না প্রশাসনের।’’ একই সমস্যায় পড়তে হয় পড়ুয়াদেরও। নদী পার হতে তাদেরও অনেক বেশি সময় লেগে যায়। তাছাড়া যে কোনও সময় একটা অঘটনের ঝুঁকিও থেকে যায়।
জলঙ্গি নদী পেরিয়ে প্রতিদিন স্কুলে যাতায়াত করেন হাঁসপুকুরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক তথা তেহট্টে বাসিন্দা মনোরঞ্জন বিশ্বাস। তিনি বলেন, “নদী পেরিয়ে স্কুলের পাঁচ কিলোমিটার পথ যেতে আমার ১৫ মিনিট সময় লাগার কথা। কিন্তু ভিড় ঠেলে বর্ষায় নৌকো বা অন্য সময় বাঁশের সাঁকো পার হতেই অনেক বেশি সময় লেগে যায়।’’ তিনি জানান, ভোরবেলায় মাঝি না থাকায় গত বছর এই নদী পার হতে দেরি হওয়ার কারণে তাঁদের স্কুল রাজ্য স্তরের নাট্য প্রতিযোগিতা থেকে বাদ যায়।
তেহট্টের বিধায়ক সিপিএমের রণজিৎ মণ্ডল বলেন, ‘‘বাম জমানায় এই সেতু তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। মাপজোক ও মাটি পরীক্ষার কাজও শেষ হয়েছিল। কিন্তু নতুন সরকার এই বিষয়ে উদ্যোগী হয়নি। আমি এই প্রসঙ্গে বহু বার বিধানসভাতেও বলেছি।’’ সমস্যার কথা মেনে নিয়ে তেহট্ট ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সঞ্জয় দত্ত বলেন, “সেতু তৈরির জন্য মাটি পরীক্ষার কাজ হয়ে গিয়েছে। এই ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রীকেও জানানো হয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি সেতু তৈরির কাজ শুরু হবে।” তবে তেহট্টের মহকুমাশাসক অর্ণব চট্টোপাধ্যায় বলছেন, “জলঙ্গির উপর সেতু তৈরি হলে নদীর দু’পাড়ের মানুষ উপকৃত হবেন। জেলায় সেতু তৈরির প্রস্তাবও আগেই পাঠানো হয়েছে। কিন্তু কবে নাগাদ সেতু তৈরির কাজ শুরু হবে সে বিষয়ে আমরাও এখনও পর্যন্ত কিছু জানি না।’’