দুগ্গা দুগ্গা

নো হেলমেট, নো পেট্রোল। জেলা জুড়ে হইহই কাণ্ড। কেউ অতি সতর্ক, কেউ আবার দিব্যি ফাঁক গলে ধাঁ। মোটরবাইক নয়, হেলমেটের পিছু নিল আনন্দবাজার কই গো, শুনছ...? মোটরবাইকে স্টার্ট দিতে যাচ্ছিলেন। এমন সময় স্ত্রীর ডাক। রাগে গজগজ করছিলেন কালীনগরের জগন্নাথ চক্রবর্তী, ‘‘উফ, সাতসকালে দিলে তো পিছন থেকে ডেকে! বাজারের লিস্টি তো পকেটে।’’

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০১৬ ০১:৩৬
Share:

কই গো, শুনছ...?

Advertisement

মোটরবাইকে স্টার্ট দিতে যাচ্ছিলেন। এমন সময় স্ত্রীর ডাক। রাগে গজগজ করছিলেন কালীনগরের জগন্নাথ চক্রবর্তী, ‘‘উফ, সাতসকালে দিলে তো পিছন থেকে ডেকে! বাজারের লিস্টি তো পকেটে।’’

হেলমেট হাতে হাসছেন স্ত্রী, ‘‘লিস্টি তো পকেটে বুঝলাম। কিন্তু মাথার জিনিসটা না পরলে হবে কী করে? আর শোনো, পিছন থেকে ডাকলে কোনও ক্ষতি হয় না। তবে হেলমেট না পরলে বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।’’

Advertisement

বৃষ্টিভেজা পথে হেলমেট মাথায় বাইক নিয়ে এগিয়ে চললেন জগন্নাথবাবু। বাড়ির সদর দরজায় দাঁড়িয়ে হাতদুটো কপালে ঠেকিয়ে স্ত্রীও অস্ফুটে বললেন, ‘‘দুগ্গা, দুগ্গা...।’’

কৃষ্ণনগর কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র অগ্নি মিত্র (নাম পরিবর্তিত)। বহু দিন ধরেই তাঁর ইচ্ছে প্রেমিকাকে বাইকের পিছনে বসিয়ে ‘লং ড্রাইভে’ যাওয়ার। প্রেমিকাও রাজি। তবে একটাই শর্ত। বাইক চালানোর সময় তিনি তো বটেই, অগ্নিকেও হেলমেট পরতে হবে।

বেজার মুখে অগ্নি বলছেন, ‘‘এতদিন চুলে হাওয়া লাগিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়ালাম। কিন্তু এ বার ফেঁসে গেলাম। পুলিশকে ফাঁকি দেওয়া যায়। কিন্তু প্রেমিকা একবার বেঁকে বসলে সব শিকেয় উঠবে। সে সব হ্যাপায় না গিয়ে জোড়া হেলমেট কিনেছি দাদা। সব কুলই বজায় থাকল।’’

হেলমেট নিয়ে কড়াকড়ির পরে বাড়ির মহিলারা কিন্তু বেজায় খুশি। জগন্নাথবাবুর স্ত্রী যেমন বলছেন, ‘‘এ বার ঠিক করেছি, হেলমেট না পরলে ওর সঙ্গে আমিও বেরোব না।’’

সাইকেলেও হেলমেট!

কে বলেছে সব চরিত্র কাল্পনিক!

‘নো হেলমেট, নো পেট্রোল’ এর পরে একটি ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ভাইরাল’ হয়ে গিয়েছে। একজন লোক হেলমেট মাথায় সাইকেল নিয়ে হাজির পেট্রোল পাম্পে। সেই ছবি ‘লাইক’, আর ‘কমেন্ট’-এর বানে ভাসছে।

তবে হোগলবেড়িয়ার স্বপন মণ্ডল সে ছবি দেখেননি। সোশ্যাল মিডিয়া তো অনেক দূরের কথা, তিনি মোবাইলও ব্যবহার করেন না। তবে এই হেলমেট না পরলে পেট্রোল মিলবে না— সে বার্তা তিনিও পেয়েছিলেন। এবং খবরটা শোনার পরে তিনি আঁতকে উঠেছিলেন।

নিজের বিঘে দশেক জমি আছে। মাসে অন্তত তিন থেকে চার বার পাম্প থেকে ডিজেল কিনতে হয়। তবে নিজের মোটরবাইক নেই। নেই হেলমেটও। অগত্যা ওই প্রৌঢ় পাড়ার এক ছেলের কাছ থেকে হেলমেট ধার নিয়ে সাইকেলে রওনা দিয়েছিলেন করিমপুর।

রাস্তার লোকজন যে তাঁর দিকে আড় চোখে তাকাননি এমন নয়। তবে সে দৃশ্য দেখে ভিরমি খাওয়ার জোগাড় হয়েছিল পাম্পের এক কর্মীর। লজঝড়ে সাইকেলে বাঁধা গোটা চারেক জেরিক্যান। বছর পঞ্চাশের ওই প্রৌঢ়ের পরনে লুঙ্গি ও গেঞ্জি। আর মাথায় একটা হেলমেট!

পাম্পের ওই কর্মী বলছেন, ‘‘দেখেই প্রথমে চমকে গিয়েছিলাম। পরে অবশ্য বুঝতে পারি, তিনি ডিজেল পাবেন না, এই ভয়ে হেলমেট পরে এসেছেন। ওঁকে ডিজেল দিয়ে অবশ্য বুঝিয়ে বলেছি, এই নিয়ম শুধু তাঁদের জন্য যাঁরা মোটরবাইক চালান।’’

সেটা শুনে অবশ্য ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়েছে স্বপনবাবুর। হাসতে হাসতে বলছেন, ‘‘আসলে এত দূর থেকে সাইকেল ঠেঙিয়ে যদি তেল না পেয়ে ফিরে আসতে হয়। তাই কোনও ঝুঁকি নিইনি। এখন অবশ্য বিষয়টি বুঝতে পেরেছি। আমি না হয় ভুল বুঝেছিলাম। কিন্তু যাঁরা বাইক চালান তাঁদের কিন্তু হেলমেট না পরার ভুলটা করা উচিত নয়।’’

বাবার মাথা ভীষণ দামী...আমার?

‘বাবার মাথা ভীষণ দামি, হেলমেটেতে ঢাকা। ছোট্ট মাথার নেই কোনও দাম, আমার মাথা ফাঁকা।’

হেলমেট নিয়ে সচেতনা বাড়াতে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল এই লাইন দু’টি। কিন্তু শিশুদের মাথায় কি হেলমেট থাকছে?

শহর ঘুরে যে ছবিটা উঠে আসছে সেটা কিন্তু বেশ ভয়ের। পেট্রোল পাম্পের নোটিস ও পুলিশের নজরদারিতে অনেকের মাথায় হেলমেট উঠেছে। বিক্রি বেড়েছে হেলমেটেরও। কিন্তু শিশুদের মাথা ফাঁকাই থাকছে। কৃষ্ণনগর সদর মোড়ের এক হেলমেট বিক্রেতা জানাচ্ছেন, প্রতিদিন গড়ে বড়দের ১৫ থেকে ২০টি বড়দের হেলমেট বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু ছোটদের হেলমেটের সংখ্যা গড়ে ১-২টি! শহরের আর এক হেলমেটে বিক্রেতা শিবু চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, বাবা কিংবা মা হেলমেট পরে বাইক চালাচ্ছেন। পিছনে সন্তান তাঁকে জড়িয়ে ধরে বাইকের পিছনে বসে রয়েছে। তার মাথা ফাঁকা। যেন বিপদ হলে শুধু বড়দের হবে। অনেকে আবার সন্তানকে নিয়ে আসছেন দোকানে। কিন্তু হেলমেটে কিনছেন শুধু নিজের জন্য। কিছু বলতে গেলে ক্রেতারা ভাবছেন যে, হেলমেট বিক্রির জন্যই তাঁরা এমন বলছেন।

হেলমেট ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে

‘এখানে হেলমেট ভাড়া পাওয়া যায়।’

না, এমন বিজ্ঞাপন তিনি এখনও দেননি। তবে মুখে মুখে বার্তাটা কিন্তু রটে গিয়েছে। গোদাডাঙা তো বটেই, আশপাশের এলাকার লোকজনও জানেন, মাথায় হেলমেট না থাকলে তিনিই মুশকিল আসান করে দেন। ভাড়া মাত্র ১০ টাকা। পেট্রোল পাম্পের পাশে এক চিলতে চায়ের দোকান। সেখানে চায়ের সঙ্গে টা ও হেলমেট দু’টোই মেলে।

মাজদিয়া থেকে মোটরবাইকে কৃষ্ণনগরে আসছিলেন বছর ত্রিশের এক যুবক। কৃষ্ণনগরে ঢোকার মুখেই পেট্রোল শেষ। শহরের ঢোকার মুখেই গোদাডাঙা। রাস্তার বাঁ দিকে পাম্প। বাইক ঠেলে তিনি সেখানে ঢুকলেন বটে, কিন্তু মাথায় যে হেলমেট নেই। অতএব পেট্রোলও নেই! তাহলে উপায়?

ঠিক তখনই দেবদূতের মতো এগিয়ে এলেন এক যুবক। কানের কাছে মুখ এনে বললেন, ‘‘ওই চায়ের দোকানটাতে যান। হেলমেট ভাড়ায় পেয়ে যাবেন।’’ সত্যিই তাই। আগন্তুককে আসতে দেখে হাসছেন ওই চা বিক্রেতা, ‘‘এই যে দাদা হেলমেট। তেল ভরেই ফেরত দিয়ে যাবেন।’’

সাকুল্যে গোটা চারেক হেলমেট। সেটাই দিনভর পাক খেয়ে যাচ্ছে এক মাথা থেকে আর এক মাথা। হেলমেট ভাড়া দিয়েই তিনি দিনে গড়ে দেড় থেকে দুশো টাকা বাড়তি আয় করছেন।

এগিয়ে আসছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ

হেলমেট নিয়ে পদক্ষেপ করতে চলেছেন কৃষ্ণনগর অ্যাকাডেমি কতৃপক্ষ। সম্প্রতি অভিভাবকদের নিয়ে তাঁরা বৈঠকও করেছেন। সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, স্কুলের পড়ুয়া ও তার অভিভাবককে হেলমেট পরতেই হবে। স্কুলের তরফে ছাপানো হবে লিফলেট ও একটি অঙ্গীকার পত্র। পড়ুয়ারা ওই লিফলেট অভিভাবকদের হাতে তুলে দেবে এবং সেই সঙ্গে তারা হেলমেট পরার প্রতিশ্রুতি আদায় করে ওই অঙ্গীকার পত্রে অভিভাবকদের স্বাক্ষর করে নিয়ে স্কুলে জমা দেবে।

কৃষ্ণনগর হাই স্কুলের গেটের বাইরে কাগজে নিখে আবেদন করা হবে—‘হেলমেট পরুন ও সন্তানকে পরান।’ সেই সঙ্গে স্কুলের প্রার্থনা চলাকালীন ছাত্রদেরও সচেতন করা হবে যাতে তারা বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের হেলমেট পরতে বাধ্য করে।

বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ স্কুলের প্রধান শিক্ষক সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘আমাদের স্কুলে কোনও পড়ুয়া বাইকে আসে না ঠিকই। কিন্তু অনেক অভিভাবক ও স্কুলের শিক্ষকেরা বাইক ব্যবহার করেন। তাঁরা যাতে হেলমেট পরেন সে ব্যাপারে আমরা ছাত্রদের দিয়ে বার্তা পাঠাব। সেই সঙ্গে শিক্ষকরাও যাতে সকলেই হেলমেট পরেন সে ব্যাপারেও আমরা মৌখিক ভাবে জানিয়েছি।’’ সোমবার থেকে এই একই ব্যাপারে নোটিস জারি করা হবে বলে জানিয়েছেন বহরমপুর আইসিআই-এর প্রধানশিক্ষক জয়ন্ত দত্ত।

কী বলছেন প্রশাসনের কর্তারা

কলকাতা আগেই শুরু করেছিল। সেই একই পথে হেঁটে নদিয়া পুলিশ প্রশাসনও নো হেলমেট, নো পেট্রোল— নির্দেশ জারি করেছে। ইতিমধ্যে জেলার সব পাম্পগুলিতে সেই ফ্লেক্সও ঝুলছে। নদিয়ার পুলিশ সুপার শীষরাম ঝাঝারিয়া বলছেন, ‘‘হেলমেট পরার প্রবণতা আগের থেকে অনেকটাই বেড়েছে। আমাদের লক্ষ্য সমস্ত বাইক চালক ও আরোহীকে হেলমেট পরানো। পাম্পগুলিতে নোটিসের পাশাপাশি জেলা জুড়ে পুলিশও কড়া নজর রাখছে। শিশুদেরও যাতে হেলমেট পরানো হয় সে ব্যাপারেও সচেতন করা হচ্ছে।’’

তবে পড়শি জেলা মুর্শিদাবাদ এখনও হেলমেট নিয়ে কোনও পদক্ষেপ করতে পারেনি। কলকাতা ও নদিয়াকে দেখে ইতিমধ্যে বহরমপুরের একটি পেট্রোল পাম্প ‘নো হেলমেট, নো পেট্রোল’ নোটিস ঝুলিয়েছেন। কৃষ্ণনাথ রোডের ওই পেট্রল পাম্পের ম্যানেজার রবীন্দ্রনাথ সাউ বলছেন, ‘‘নোটিস বোর্ড টাঙিয়েছি বটে। তবে সরকারি ভাবে কোনও নির্দেশ না পাওয়ায় কঠোর ভাবে তা পালন করতে পারছি না।’’

মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপার মুকেশ কুমার বলেন, ‘‘আগামী দু’দিনের মধ্যে জেলার পেট্রোল পাম্প মালিকদের কাছে নির্দেশ পাঠানো হবে। সেই সঙ্গে পেট্রোল পাম্পে ব্যানার-ফেস্টুন টাঙানোর নির্দেশও জারি করা হবে।’’

পুনশ্চ

আর ২১ জুলাই? পুলিশ বলছে, ‘একটু শিথিল তো হতেই হবে ভাই।’ শহিদ দিবসে খুল্লমখুল্লা খোলা মাথায় তাই ঘুরে বেড়ালেন জেলা-শহরের তৃণমূল কর্মী সমর্থকেরা। বৃহস্পতিবার কলকাতা ও জেলার রাস্তাতেও চোখে পড়েছে সেই একই দৃশ্য। খোলা মাথায় একটা বাইকেই তিন জনকেও ঘুরতে দেখা গিয়েছে।

(তথ্য সহায়তা—সুস্মিত হালদার, কল্লোল প্রামাণিক ও শুভাশিস সৈয়দ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement