রাস্তায় বাস দাঁড়িয়ে এভাবেই চলে ওঠানামা। —নিজস্ব চিত্র।
বেলা পৌনে এগারোটা। কৃষ্ণনগর-করিমপুর রাজ্য সড়কে করিমপুরগামী বাসটা চাপড়া বাসস্ট্যান্ডে থামতেই হইহই করে লোকজন বাসে উঠলেন। বাস থামার ঠিক আগে তাড়াহুড়ো করে রাস্তা পার হতে গিয়ে কোনওরকমে দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে গেল এক স্কুল ছাত্রী। সৌজন্যে, চালকের তৎপরতা। বাড়ির টুকিটাকি কাজ সেরে স্কুলে যেতে এমনিতেই কিঞ্চিৎ দেরি হয়েছে ওই ছাত্রীর। তাই এমন হুটোপাটা। কিন্তু দুর্ঘটনার হাত থেকে রেহাই পেয়ে কোনও হেলদোল না দেখিয়ে নির্বিকারভাবে রাস্তা পেরিয়ে গেল সে। ভাবখানা এমন যে, এ তো হামেশাই ঘটে। এত ভেবে কী লাভ! সঙ্কীর্ণ চাপড়া বাসস্ট্যান্ডে ছোটখাটো ভুরিভুরি দুর্ঘটনা দেখে লোকজন বিপদ নিয়ে সেভাবে ভাবে না।
নদিয়া জেলার সীমান্ত ঘেঁষা চাপড়া এলাকা যোগাযোগ ব্যবস্থার নিরিখে সুবিধাজনক। তাই আশপাশের সীমান্তের বিভিন্ন গ্রামের সম্পন্ন লোকজন চাপড়াতে স্থায়ী ডেরা করেছেন। ফলে দিন দিন বেড়েছে এই শহরের লোকসংখ্যা। তাছাড়া স্কুল-হাই মাদ্রাসা মিলিয়ে এখানে প্রায় গোটা দশেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। রয়েছে একটি কলেজও। বাঙালঝি মহাবিদ্যালয়। রয়েছে থানা ও ব্লক প্রশাসনের কার্যালয়। তাই নিত্যদিন বিভিন্ন দরকারে সকাল হলেই লোকজনের ভিড় জমে চাপড়ায়। তাই এলাকায় এমনিতেই দিনের বেলায় লোকজন গিজগিজ করে। চাপড়া এলাকা দিয়ে কৃষ্ণনগর-করিমপুর-সহ বিভিন্ন রুটের প্রায় ১৬০টি বাস প্রতিদিন যাতায়াত করে।
কিন্তু এমন ঘন জনবসতিপূর্ণ এলাকা ও এত বাসের আধিক্য থাকা সত্ত্বেও চাপড়ায় আজও পর্যন্ত কোনও স্থায়ী বাসস্ট্যান্ড তৈরি হল না। ফলে সঙ্কীর্ণ কৃষ্ণনগর-করিমপুর রাজ্য সড়কের উপরেই চাপড়ার অস্থায়ী বাসস্ট্যান্ডের যেখানে সেখানে দাঁড়িয় থাকে বিভিন্ন রুটের বাস। বাসের সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকে লছিমন, লরি থেকে শুরু করে ভ্যান-রিকশাও। রাস্তার ধারে অস্থায়ী বাসস্ট্যান্ডে যানবাহনের এই আধিক্যে দিনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তৈরি হয় প্রবল যানজট। স্থানীয় লোকজনের দাবি, যানজটের দরুন বাসস্ট্যান্ড চত্বরে পা ফেলাই দায় হয়ে পড়ে। সব জায়গাতেই দাঁড়িয়ে থাকে বাস-লরি। এই যানজটের দরুণ ধৈর্য্য হারিয়ে লোকজন অনেক সময়ই তাড়াহুড়ো করতে রাস্তা পেরোতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন। স্থানীয় এক দোকানদার বলেন, ‘‘চোখের সামনে আকসার দুর্ঘটনা ঘটে। তাই এখন আর দুর্ঘটনার ভয় করে না। তাই ওই ছাত্রীর সাম্ভাব্য বিপদ দেখেও কারও কোনও হেলদোল নেই।’’
চাপড়ার মানুষ যানজট-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি লাভের আশায় একটা স্থায়ী বাসস্ট্যান্ডের দাবিতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে প্রশাসনের কাছে একাধিকবার দরবার করেছেন। কিন্তু তাঁদের দাবি, সব মহল থেকেই কেবলই মিলেছে আশ্বাস। প্রতিশ্রুতি। কিন্তু কেউ কথা রাখেনি। আশ্বাস থেকে আশ্বাসেই। আজও কাজের কাজ কিছুই হল না।
যানজটের সমস্যা নিয়ে রীতিমতো উদ্বেগ প্রকাশ করে স্থানীয় হাটচাপড়া কিং এডওয়ার্ড হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক বিকাশ মণ্ডল বলেন, ‘‘যানজটের কারণে চাপড়ার মানুষকে প্রতি মুহুর্তে জেরবার হতে হয়। আমাদের স্কুলের ছেলে-মেয়েদের নিয়ে চিন্তা হয়। কোন দিন না বড়সড় কোন দুর্ঘটনা ঘটে যায়!’’ তাঁর খেদ, কিন্তু সমস্যা সমাধানে কেউই তৎপর নয়। বাঙ্গালঝির বাসিন্দা প্রণয় দত্ত নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। তিনি বলেন, ‘‘ছোট থেকেই দেখছি এলাকায় কোনও স্থায়ী বাসস্ট্যান্ড নেইয়। ফলে যানজট লেগেই থাকে। যানজট ঠেলে অনেক সময় বাস ধরতে সমস্যা হয়। ফলে কলেজে ঠিক সময়ে যেতে পারি না।’’
অস্থায়ী বাসস্ট্যান্ড ও তার থেকে উদ্ভূত নিত্য যানজট নিয়ে চিন্তিত নদিয়া জেলা বাস মালিক সমিতির কর্তাব্যক্তিরাও। সমিতির পক্ষে অসীম দত্ত বলেন, ‘‘আমরা প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরে একাধিকবার চাপড়ায় স্থায়ী বাসস্ট্যান্ডের দাবিতে ডেপুটেশন দিয়েছি। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। প্রতিবারই স্রেফ প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনও কাজ হয়নি।’’
সমস্যা সমাধানে কী করছে প্রশাসন? চাপড়ার বিডিও রীনা ঘোষ বলেন, ‘‘বিডিও অফিসের উল্টো দিকের ফাঁকা জায়গায় স্থায়ী বাসস্ট্যন্ড তৈরির পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়। কিন্তু ওই জমি নিজেদের দাবি করে এলাকার কিছু লোক আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। তাই ওখানে বাসস্ট্যান্ড বানানো যাচ্ছে না।’’ অন্য কোনও বিকল্প জায়গায় কেন বানানো হচ্ছে না বাসস্ট্যান্ড? রীনাদেবীর জবাব, ‘‘বিকল্প জায়গার সন্ধান এখনও অবধি মেলেনি।’’
অতএব, আপাতত যানজটের নিত্যযন্ত্রণা সহ্য করাই ভবিতব্য চাপড়াবাসীর।