সারা জীবন মুখঝামটা দিয়ে তর্পণে সব মাফ?

গ্রামে কারও বাড়িতেই রেডিও ছিল না তখন। কাকভোরে জলঙ্গির দু’পাড়ে দু’টো চায়ের দোকানে বেজে উঠত রেডিও। তিন বার শঙ্খধ্বনি। দু’পারের রেডিও থেকে জলঙ্গির গাঢ় সবুজ জল ছুঁয়ে ভেসে আসত বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কণ্ঠ— “আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জরী।”

Advertisement

অনল আবেদিন ও দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

বহরমপুর ও নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০২:২২
Share:

গ্রামে কারও বাড়িতেই রেডিও ছিল না তখন। কাকভোরে জলঙ্গির দু’পাড়ে দু’টো চায়ের দোকানে বেজে উঠত রেডিও।

Advertisement

তিন বার শঙ্খধ্বনি। দু’পারের রেডিও থেকে জলঙ্গির গাঢ় সবুজ জল ছুঁয়ে ভেসে আসত বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কণ্ঠ— “আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জরী।”

গ্রামের পুরুষেরা একে একে জড়ো হতেন নদীর পাড়ে। হাল্কা ঠান্ডায় ধুতির খুঁটে গা-মাথা ঢাকা এক দল মানুষ নিস্তব্ধ হয়ে বসে শুনে যেতেন দুর্গার সৃষ্টি, রণযাত্রা, বিজয়— ‘যা দেবী সবর্ভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা’ ...চণ্ডীপাঠ আর পঙ্কজ মল্লিকের সুরে চরাচর ভাসানো গানের পর গান।

Advertisement

শ্রোতারা স্থির। সবাই যেন ধ্যানে বসেছেন। ‘‘বাবার মতো অনেককেই দেখতাম, শেষের দিকে কাঁদছেন। কেন, তা তখন বুঝতাম না,’’ বলতে বলতে ফের স্মৃতির সরণিতে হারিয়ে যান আশি ছুঁইছুঁই বর্ধিষ্ণু চাষি শিবপদ বিশ্বাস। ‘‘সে শোনা তো শোনা নয়! দুর্গতিনাশিনীর অসুরদলন একেবারে চোখের সামনে দেখতে পেতাম যেন। রণচণ্ডীর রণং দেহী রূপ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ফুটে উঠত চোখের সামনে। আজকের হরেক চ্যানেলে, টিভিতে সচিত্র সেই আখ্যান ওই রকম ফুটিয়ে তুলতে পারে না’’— এক নিঃশ্বাসে বলে গিয়ে থামেন চক-ইসলামপুরের প্রৌঢ় ললিত গনাই।

মহালয়া মানে পিতৃপক্ষের অবসান, দেবীপক্ষের সূচনা। প্রাতে পিতৃতর্পণ। পিতৃপক্ষ বস্তুত প্রিয়পক্ষ। যাঁরা বিশ্বাসী, তাঁরা বিশ্বাস করেন, এই সময়ে পরলোকগত প্রিয়-পরিজন ফিরে আসেন মর্ত্যের মায়ায়। বৃষ্টির পথ বেয়ে নেমে আসেন তাঁরা। আর জীবিত উত্তরপুরুষেরা জলদান করে তাঁদের তৃপ্ত করেন। সেই ‘তৃপ’ ধাতু থেকেই ‘তর্পণ’। কিন্তু আম বাঙালির ঘরে-ঘরে কবেই যেন মহালয়া হয়ে উঠেছিল রেডিওর আওয়াজে জেগে ওঠা একটা আশ্চর্য ভোর। শোনা শেষ হলে তবে নদীমুখো হওয়া।

গঙ্গার পাড়ে আদুল গায়ে, ভেজা শরীরে, পরনে দুধসাদা ধুতি গলায় গামছা জড়িয়ে জলে পা ডুবিয়ে বসে আছেন কত মানুষ। তাঁদের হাতে ধরা তামার কুশি। তার মধ্যে জলে ডুবে যব, তিল, গঙ্গামাটি, ফুল, বেলপাতা তুলসী। সৈয়দাবাদের ষাটোর্ধ্ব মুরারী মণ্ডল বলেন, ‘‘পুরোহিত মন্ত্রোচ্চারণ করবেন আর সেই মতো পিতৃতর্পণ হবে, এটাই ছিল বিধান। তবে এখন অনেকে মাতৃতর্পণও করেন।’’ সেই দলে আছেন বড়়ঞার বিএ পাশ যুবক কুন্তল ভট্টাচার্যেরা তিন ভাই। কয়েক বছর ধরে বহরমপুরে গঙ্গায় তাঁরা বাবা-মা দু’জনের উদ্দেশ্যেই তিল-জল-তণ্ডুল দিয়ে আসছেন। কুন্তলের কথায়, ‘‘দেবী দুর্গার তো জগজ্জননী। তাঁর আগমনের আগে পিতৃতর্পণ হবে আর মাতৃতর্পণ হবে না? তা আবার হয় নাকি!’’ উল্টো দিকে, মহিলারা যে তর্পণ করতে পারেন, তা মানেন না গোঁড়া হিন্দুদের একটা অংশ। তাঁদের শাস্ত্রকে তুড়ি মেরে প্রতি বছর তর্পণ করে আসছেন বহরমপুরের অরুণা গুহ। অবসরপ্রাপ্ত নার্স অরুণার যুক্তি, ‘‘উত্তর থেকে দক্ষিণ ভারতের বহু মন্দিরে-ধামে গিয়েছি। সব জায়গায় কিন্তু শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে মহিলাদের বঞ্চিত করা হয় না।’’

গৌরগঙ্গার দেশ নবদ্বীপের প্রতি ঘাটেই সকাল থেকে ভিড় থইথই। কাকদ্বীপ থেকে কলকাতা, মানুষ ছুটে এসেছেন ‘গৌরগঙ্গায়’ তর্পণ করবেন বলে। যত দিন যাচ্ছে, ভিড়ের বহর যেন বাড়ছে। রানির ঘাট থেকে কয়েক পা দূরেই বেসরকারি বৃদ্ধাশ্রম। রাস্তা লাগোয়া বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে আছেন এক দল নারী-পুরুষ। বিহ্বল চোখে দেখছেন সামনের রাস্তায় তর্পণ ভিড়। গাড়ির পর গাড়ি থেকে সপরিবার নামছেন প্রতিষ্ঠিত লোকজন। তর্পণের সঙ্গে এক দিনের অন্য রকম একটা বেড়ানোও বটে।

দেখেশুনে প্রায় ফুঁপিয়ে ওঠেন এক বৃদ্ধা। বলেই ফেলেন, “সারা জীবন অপমান মুখঝামটা দিয়ে, মরার পরে এখন মন্তর পরে জল দিলেই কি সব মাপ হবে বাবা? অতই সহজ!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন