ডমরু চুপ, গর্জে উঠল ডিজে বক্স

পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারা ভাঙা রেকর্ডের মতো বাজিয়ে চলেন, ‘‘ডিজে নিষিদ্ধ। তা কোনও ভাবেই বরদাস্ত করা হবে না। ডিজের খবর পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’

Advertisement

বিমান হাজরা

রঘুনাথগঞ্জ শেষ আপডেট: ০৫ মার্চ ২০১৯ ০১:৪৩
Share:

ঝালাপালা: শিবরাত্রির দিন চলেছে ভক্তের দল। সোমবার রঘুনাথগঞ্জে। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়

আপদের নাম ডিজে! বিপদ বললেও বোধহয় বাড়াবাড়ি হবে না।

Advertisement

পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারা ভাঙা রেকর্ডের মতো বাজিয়ে চলেন, ‘‘ডিজে নিষিদ্ধ। তা কোনও ভাবেই বরদাস্ত করা হবে না। ডিজের খবর পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’

যা শুনে শহরের বাসিন্দারা বলছেন, ‘‘ডিজে তো কখনও নিশ্চুপে চলে বলে শুনিনি। সে নিজের দাপট নিজেই জানান দেয়। সে আওয়াজ পুলিশ-প্রশাসনের কানে না পৌঁছলে আর কী করা যাবে!’’

Advertisement

কথাটা কথার কথা নয়। বিয়ে বাড়ি হোক বা পিকনিক—ডিজে বিনে গতি নেই। পিকনিকে খাসির মাংস হচ্ছে না? কোনও চিন্তা নেই। ডিজে থাকলেই চলবে। বিয়ে বাড়িতে অন্য বাজেট কমালেও আপত্তি নেই। কিন্তু ডিজে আনতেই হবে। পুজো-পরবে কোনও ভাবেই ডিজের সঙ্গে আপস নয়!

এই ডিজে-নামচায় বিস্তর অভিযোগ আসে, গন্ডগোল হয়, প্রতিবাদ করলে ছিটকে আসে হুমকি, মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় এই শব্দ-দৌরাত্ম্যের প্রতিবাদ করে কান্দির এক গ্রামে এক বৃদ্ধকে পর্যন্ত খুন হতে হয়েছে।

তবুও হুঁশ ফেরেনি। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার মরসুম বলেও কেউ পরোয়া করল না। সোমবার শিবরাত্রি উপলক্ষে রঘুনাথগঞ্জ শহর জুড়ে দিনভর দাপিয়ে বেড়াল ডিজে।

কোথাও পিকআপ ভ্যান, কোথাও ট্রাক্টর, কোথাও আবার লছিমনে (যন্ত্রচালিত ভ্যান) সওয়ার হয়ে ঢাউস ডিজে বক্স গর্জে গেল সকাল থেকে সন্ধে। সেই গর্জনকে সমানে সঙ্গ দিয়ে গেল একাধিক জেনারেটর।

এ দিন সকাল থেকে কাতারে কাতারে লোকজন রঘুনাথগঞ্জ শহরে ঢুকেছেন গঙ্গাস্নানে। প্রত্যেকটি দলের সঙ্গেই ছিল গাড়িতে রাখা ডিজে।

এলাকায় উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা চলেছে বহু স্কুলেই। সোমবার পরীক্ষা না থাকলেও পরীক্ষা রয়েছে আজ, মঙ্গলবার। বহু বাড়িতেই রয়েছে পরীক্ষার্থী। সে সবের তোয়াক্কা করেনি কেউই। সেই শব্দ থামানোর চেষ্টাও করতে দেখা যায়নি পুলিশ কিংবা প্রশাসনকে।

ভাগীরথীর পাড়েই বাড়ি এক উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর। তার কথায়, ‘‘দিনভর ডিজের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে গেলাম। জানলা বন্ধ করেও সেই বিকট শব্দ আটকানো যায়নি। সকলেই বহিরাগত। কাকে কী বলব! আর বলতে গেলেই অশান্তি হবে। তাই মুখ বুজেই সহ্য করতে হয়েছে।’’

স্থানীয় একটি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক উৎপল মণ্ডল বলছেন, “পরীক্ষার্থীদের কথাটা পর্যন্ত কেউ ভাববে না এক বার! ডিজে তো নিষিদ্ধ বলেই জানি। রঘুনাথগঞ্জ শহরে ঢোকার মুখেই ট্রাফিক রয়েছে। তাদের সামনে দিয়ে তা হলে এই শব্দ-দানব শহরে ঢুকল কী করে? একটা বা দুটো নয়, অন্তত ১৮ থেকে ২০ টি দলের সঙ্গে ডিজে ঢুকেছে।”

ডিজের তাণ্ডব যে কতটা ভয়ঙ্কর তা হাড়ে হাড়ে বোঝেন ধুলিয়ানের ঘোষপাড়ার বাসিন্দারা। সেখানকার পুরসভার লজে কোনও অনুষ্ঠান হলেই ডিজে চলে। অতিষ্ঠ হয়ে পুলিশ ও পুরসভার দ্বারস্থ হয়েছিলেন স্থানীয় লোকজন। তার পরে কিছুটা রেহাই মিলেছে।

ফেব্রুয়ারিতে কান্দির এক গ্রামে সরস্বতী পুজো উপলক্ষে তারস্বরে বাজছিল ডিজে। মাধ্যমিক পরীক্ষার কথা জানিয়ে ডিজে বাজানোর প্রতিবাদ করেছিলেন ৬৬ বছরের বৃদ্ধ হারাধন মাল। ডিজে তো বন্ধ হয়নি। উল্টে বেধড়ক মারধর করা হয় ওই বৃদ্ধকে। তাঁকে কান্দি মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। ওই ঘটনায় চার জনকে পুলিশ গ্রেফতার করলেও এখনও পর্যন্ত মূল অভিযুক্ত পলাতক।

শিবরাত্রির দিন গঙ্গাস্নানে আসার রেওয়াজ দীর্ঘ দিনের। এ দিনও জেলা সদর বহরমপুরেও বাঁক কাঁধে এসেছেন কয়েক হাজার ভক্ত। কিন্তু সেখানে অবশ্য সে ভাবে ডিজে-দৌরাত্ম্য নজরে পড়েনি। ধুলিয়ান শহরেও গঙ্গাস্নানে বেশ ভিড় ছিল। সেখানে ডিজে না থাকলেও তাসা, ঢোল ও কাঁসির আওয়াজে সরগরম ছিল এলাকা।

কিন্তু রঘুনাথগঞ্জ শহরের ডিজের দাপট দেখে অনেকেই বলেছেন, ‘‘এটা শিবরাত্রি না ডিজে উৎসব! পরীক্ষার কথা ভেবে শিবের ডমরুটা পর্যন্ত নিশ্চুপে আাছে। অথচ ডিজে যেন বাঁধনছাড়া!’’ এ শহরে বেশিরভাগ লোকজন এসেছেন ঝাড়খণ্ডের মহেশপুর, পাকুড় ও সাগরদিঘির বন্যেশ্বর, সেন্ডা, বীরভূমের পাইকর, মুরারই থেকে। গঙ্গাস্নানের সময়েও ডিজে বন্ধ হয়নি।

সেন্ডার বিষ্ণু মাঝির সঙ্গে ছিলেন জনা পনেরো সঙ্গী। ট্রাক্টরের পিছনে ডালা খুলে সাজানো ছিল ডিজের বক্স।

শহরের মধ্যে নিষিদ্ধ ডিজে নিয়ে ঢুকেছেন কেন?

বিষ্ণুর উত্তর, “উৎসবের দিন তো! ছেলেপুলে একটু আনন্দ করবে বলল। তাই কয়েক ঘণ্টার জন্য ভাড়া করেছি। আ উৎসবের দিন এত নিয়ম-টিয়ম মানলে চলে নাকি!’’

বীরভূমের মুরারইয়ের বিক্রম রায়ের দলের সঙ্গে পিকআপ ভ্যানে গর্জে গিয়েছে ডিজে। শিবের মাথায় জল ঢালতে তাঁরা যাবেন ঝাড়খণ্ডের মহেশপুরে। বিক্রম বলছেন, “শিবের পুজো বলে কথা! একটু গর্জন তো হবেই।”

সাগরদিঘির বন্যেশ্বরের রতন দাসের সঙ্গী ছিলেন প্রায় ৩৫ জন। তাঁদের ডিজের বাহন ছিল ট্রাক্টরে। রতন বলছেন, “গ্রামে রাতভর চলবে উৎসব। রাত জাগতে হবে বলেই ডিজে ভাড়া করেছি।”

জঙ্গিপুরের এসডিপিও প্রসেনজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, “ডিজে নিষিদ্ধ। কী ঘটেছে তা খোঁজ নিয়ে দেখে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন