চায়ের কাপে তুফান তুলে চর্চার কেন্দ্রে ‘পিস্তল ড্যান্স’

—‘‘উফ্, নাচ একটা দেখলাম বটে!’’ বছর সত্তরের বৃদ্ধের কথা শেষ না হতেই হইহই করে উঠলেন পাশে বসা এক প্রৌঢ়, ‘শুধু নাচটাই দেখলেন মশাই! আর মেজাজটা?

Advertisement

সুজাউদ্দিন ও কৌশিক সাহা

ডোমকল ও কান্দি শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০১৫ ০০:১১
Share:

কান্দির মিছিলে অস্ত্র-উল্লাসের জবাব দিতে সোমবার মোহনবাগান ময়দানে সভা করল তৃণমূল। ছিলেন শুভেন্দু অধিকারী, অনুব্রত মণ্ডল-সহ জেলা নেতারা।— গৌতম প্রামাণিক

—‘‘উফ্, নাচ একটা দেখলাম বটে!’’

Advertisement

বছর সত্তরের বৃদ্ধের কথা শেষ না হতেই হইহই করে উঠলেন পাশে বসা এক প্রৌঢ়, ‘শুধু নাচটাই দেখলেন মশাই! আর মেজাজটা?’ এ বার যেন কিঞ্চিত মেজাজ হারালেন উল্টো দিকে বসে থাকা আর এক বৃদ্ধ। চায়ের কাপটা ঠক করে কাঠের বেঞ্চের উপরে রেখে বললেন, ‘‘আপনারা ওই নাচ আর মেজাজ নিয়েই থাকুন। তাসার সঙ্গে কোমর দুলিয়ে পিস্তলটা কী ভাবে উঁচিয়ে ছিল, কই সেটা তো একবারও বলছেন না!’’

এ বার রেগে গেলেন বছর সত্তরের ওই বৃদ্ধ। পাঞ্জাবির হাতটা একটু গুটিয়ে গলা চড়িয়ে শুরু করলেন, ‘‘তোমাদের বাপু এই এক দোষ। পুরো কথাটাই শেষ করতে দাও না। তার আগেই খালি বকবক। পিস্তলের ব্যাপারটাই তো...।’’ দিন পনেরো আগের ‘পিস্তল ড্যান্স’ নিয়ে তর্কটা যেই জমে উঠেছে, ঠিক সেই মাহেন্দ্রক্ষণে কেটলি হাতে উঠে এসেছেন স্বয়ং দোকানদার। তর্কের আঁচ বুঝে কথাটা পেড়েই ফেললেন, ‘‘কাকাবাবুদের আর কাপ করে চা দিই তা হলে।’’ ডোমকলের একটি চায়ের দোকানে কাপের পর কাপ চা উড়ে যাচ্ছে এ ভাবেই।

Advertisement

‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’—এর লুঙ্গি ড্যান্স এখন সুদূর অতীত। টিভির পর্দায় নাচ নিয়ে যে অনুষ্ঠান চলে তা নিয়েও বিশেষ রা কাড়ছেন না অনেকেই। চায়ের দোকান, পাড়ার মাচা কিংবা সান্ধ্য আলোচনায় এখনও সবথেকে বেশি চর্চিত বিষয় কান্দির ‘পিস্তল ড্যান্স’। মুর্শিদাবাদের কান্দি থেকে কাতলামারি, ডোমকল থেকে ডাঙাপাড়া কিংবা লালবাগ থেকে লালগোলা—ছবিটা কমবেশি একই।

পিছিয়ে নেই জেন ওয়াইও। ফেসবুক, হোয়াটস আপের সৌজন্যে ওই পিস্তল নাচের ভিডিও এখন মোবাইলে মোবাইলে ঘুরছে। ফেসবুকে উঠে এসেছে, ‘বাচ্চাছেলে খেলনা বন্দুক নিয়ে একটু আনন্দ করছে। এই নিয়ে এত হইচই করার কী আছে!’, ‘মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করার উপকরণ এখন অনেকের কাছে খেলনাই বটে।’ কিংবা ‘বিহার, ইউপি-র সংস্কৃতি এ বার বাংলাতেও ঢুকে পড়ল’ —এর মতো নানা ‘কমেন্ট’।

ডোমকলের রাজ্য সড়কের পাশের ওই চায়ের দোকানে বসে প্রাথমিক স্কুলের এক শিক্ষক বলছিলেন, ‘‘এলাকার ঘটনা সংবাদমাধ্যমে উঠে এলে সাড়া পড়ে। বেশ কিছুদিন হইচইও হয়। তারপর থিতিয়েও যায়। কিন্তু কোনও কোনও ঘটনার রেশ থাকে অনেকদিন। যেমন কান্দির ঘটনা।’’ তিনি জানান, মুর্শিদাবাদ ঘটনাবহুল জেলা। কয়েক বছর আগে ডোমকলে পঞ্চায়েত ভোটের সময় রাজনৈতিক সংঘর্ষে কয়েকজন মারা গিয়েছিলেন। তখন মৃত্যুর খবর জানতে চেয়ে অনেকেই খোঁজ নিয়েছিলেন, ‘ক’টা উইকেট পড়ল?’ ওই ঘটনার পরে ‘উইকেট’ প্রসঙ্গ ছড়িয়ে পড়েছিল তামাম জেলায়।

সম্প্রতি বন্‌ধ সফল করতে বহরমপুরের পথে নেমেছিলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। জামা খুলে, দু’হাত তুলে তাঁর হুঙ্কার ছিল, ‘‘আয় তোরা! পুলিশ, চালা গুলি! হিম্মত থাকলে আমার বুকে গুলি চালা! দেখি তোদের কত গুলি আছে। চালা লাঠি!’’ সেই প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কটাক্ষ ছিল, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে যা মানায় সবাইকে তা মানায় না। এমন ঘটনা ও মন্তব্য নিয়ে রাজ্য রাজনীতি তো বটেই, ‘লাইক’ ও ‘কমেন্টে’ ভরে উঠেছিল ফেসবুকের ‘পেজ’। তখনও আড্ডায়, তর্কে, তুফান উঠেছিল চায়ের কাপে। নবাবের জেলায় বেশ ক’দিন মুখে মুখে ঘুরল—‘চালা গুলি।’

কান্দি শহরেই চায়ের দোকান অবিনাশ সরকারের (নাম পরিবর্তিত)। বেশ পুরনো চায়ের দোকান। সকাল সন্ধ্যে ভিড়ও হয় ভালই। একাধিক বাংলা সংবাদপত্র তিনি দোকানে রাখেন। যার নিট ফল—চায়ের সঙ্গে টা থাকুক বা না থাকুক আড্ডা বা তর্কের বিষয়ের কোনও অভাব হয় না। বছর পঞ্চাশের অবিনাশবাবু বলছিলেন, ‘‘বহু বিষয় নিয়েই খদ্দেররা আড্ডা দেন। কিছুদিন পরে উঠে আসে নতুন প্রসঙ্গ। কিন্তু নিজের শহরের এমন ঘটনার পরে আলোচনায় বিষয় যেন আর পাল্টাচ্ছে না। কান্দির পিস্তল ড্যান্সের পরে মোদীর বিদেশ সফরও কেমন পানসে ঠেকেছে।’’

আড্ডার পাশাপাশি রসিকতাও কিছু কম হচ্ছে না। কান্দির আর একটি চায়ের দোকানে চা-বিস্কুট খেয়ে দাম মেটাচ্ছিলেন স্থানীয় দুই যুবক। বিল হয়েছিল সাড়ে এগারো টাকা। তাঁরা দু’টো দশ টাকার নোট দিলে ওই চা বিক্রেতা বলেন, ‘‘খুচরো দে না বাবা। এখন সাড়ে আট টাকা ফেরত দেব কী করে!’’ গলাটা গম্ভীর করে ওই দুই যুবকের একজন বললেন, ‘‘সাতসকালে খুচরো ঝামেলা ভাল লাগছে না কাকা। এখনই কিন্তু পিস্তল নিয়ে এই দোকানের মধ্যেই নাচতে শুরু করব।’’ প্রথমে কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা। তারপর হো হো করে হাসতে শুরু করলেন দোকানভর্তি লোকজন। ‘‘এই শুরু হল। সারাদিন এখন এই এক ক্যাসেট বাজবে।’’

গত ২১ সেপ্টেম্বরের মিছিলে পিস্তল উঁচিয়ে নাচের ঘটনার পরে ঘরে-বাইরে চাপের মুখে পড়ে ভাবমূর্তি ফেরাতে সোমবার কান্দির মোহনবাগান ময়দানে সমাবেশ করে তৃণমূল। উপস্থিত তৃণমূল নেতৃত্ব গোটা ঘটনার দায় চাপান কংগ্রেস এবং সংবাদমাধ্যমের একাংশের ঘাড়ে। জেলা কংগ্রেস নেতৃত্ব সেই অভিযোগ উড়িয়ে তৃণমূল নেতাদের দাবিকে প্রলাপ বলে কটাক্ষ করেছেন।

সোমবারের সান্ধ্য আড্ডাতেও সেই প্রসঙ্গ ওঠে। তরজায় এক যুবকের সংযোজন, ‘‘এখনই ক্লান্ত হলে হবে! এ তো কলির সন্ধ্যে গো। বিধানসভার আগে না জানি আরও কত কী
দেখতে হবে!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন