পরবের পথ চেয়ে জেগে ওঠে চরাচর

পিঠোপিঠি দু’টো পরব। পাশাপাশি দু’টো দেশ। মাঝে পড়ে থাকে চর। অবহেলায়, অবজ্ঞায়। যন্ত্রণার সেই বারোমাস্যায় দখিনা বাতাসের মতো হাজির হয় ইদ কিংবা দুগ্গা পুজোও। গা থেকে বর্ষার শ্যাওলা ঝেড়ে জেগে ওঠে সীমান্তের সেই জনপদগুলো। পরবের সেই প্রস্তুতি ঘুরে দেখল আনন্দবাজার ‘জলের পুকা জলে যা, আমার সিলেট শুকিয়ে যা...।’ ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে বেশ কয়েকজন খুদে পড়ুয়া। হাতে ভাঙা একফালি ভিজে স্লেট। কুলোর মতো ঝেড়ে যাচ্ছে। আর আওড়ে যাচ্ছে—‘জলের পুকা...।’ এ বারে হুঙ্কার দিলেন শিক্ষক, ‘‘ওরে স্লেট শুকোতে কতক্ষণ লাগে?

Advertisement

সুজাউদ্দিন ও গৌরব বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০১:২২
Share:

‘জলের পুকা জলে যা, আমার সিলেট শুকিয়ে যা...।’

Advertisement

ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে বেশ কয়েকজন খুদে পড়ুয়া। হাতে ভাঙা একফালি ভিজে স্লেট। কুলোর মতো ঝেড়ে যাচ্ছে। আর আওড়ে যাচ্ছে—‘জলের পুকা...।’

এ বারে হুঙ্কার দিলেন শিক্ষক, ‘‘ওরে স্লেট শুকোতে কতক্ষণ লাগে? তাড়াতাড়ি এসে হাতের লেখা শেষ কর।’’ হইহই করে ভিড়টা ঢুকে গেল ঘরের ভিতরে।

Advertisement

মহাদেবপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়। সাকিন রানিনগর।

পদ্মার ঘোলা জলে ডুবে আছে চরাচর!

কোথাও হাঁটুজল, কোথাও কোমর সমান। সেই জল উপেক্ষা করার জো নেই। খেত-খামার, স্কুল বাজার সবই সেই জল মাড়িয়ে।

স্কুলের শিক্ষক আলমগির হোসেন বলছেন, ‘‘জলের পোকা আর কোথায় যাবে! দেখছেনই তো, চারদিকে জল আর জল। ফি বছরেই এই এক দুর্গতি।’’

তাহলে কি দুর্গতিনাশিনী এ বারে চরে পা দেবে না? মুখ ফিরিয়ে থাকবে ইদুজ্জোহা?

‘‘কী বলছেন কর্তা? সম্বচ্ছরে ওই পরবগুলো আছে বলেই না এত কষ্ট সহ্য করা যায়। দাঁতে দাঁত চেপে বেঁচে থাকা যায়। হয়তো তেমন আড়ম্বর হবে না। হ্যালোজেন জ্বলবে না। কিন্তু হবে, ইদ-পুজো সবই হবে।’’ এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে হাঁফাচ্ছেন রানিনগর চরের বৃদ্ধ আসমত শেখ।’’

দুয়ারে আরও একটা ইদ। পাট বিক্রির টাকা আছে। সেমুই, সরু চালের খুশবু আছে। কিন্তু মন ভাল নেই মুরুটিয়ার সাবিনা বিবির। কারণ এ বারের ইদেও তাঁর সঙ্গে দেখা হবে না কুষ্টিয়ার বোনের। রংমহলের ইন্তাজ আলিও দাঁড়িয়ে থাকবেন না পাকশি ‘বর্ডারে’।

ফি বছর ইদের দিন দু’পার বাংলার মানুষ ভিড় করতেন সীমান্তে। কিছুক্ষণের জন্য হলেও রুখু কাঁটাতার ভেসে যেত আবেগে। কিন্তু গুলশন কাণ্ডের পরে সে সব বিলকুল বন্ধ। ইদ-উল-ফিতরেও হয়নি। এ বারেও সম্ভবনা প্রায় নেই। ‘‘বিএসএফ ঝুঁকি নিতে চাইছে না। আমরাও জোর ওদের রাজি করানোর সাহস দেখাচ্ছি না। কখন কী হয়ে যায়, কে বলতে পারে!’’ বলছেন পিপুলবেড়িয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য তৃণমূলের আদের আলি মণ্ডল।

তাঁর আফশোস, ‘‘ইদ হোক বা দুর্গাপুজো, ওপার বাংলা থেকে এক চক্কর ঘুরে আসতে না পারলে যেন আমাদের পরব পূর্ণ হত না। কুষ্টিয়ার মিষ্টি ও বিরিয়ানির স্বাদ আজও মুখে লেগে রয়েছে। কিন্তু সে সব তো অতীত।’’ দিঘলকান্দি, ধারা, মথুরাপুর, পাকশি, ব্রজনাথপুরে তাই ইদ-পুজো দুই-ই আছে। সেই সঙ্গে আছে মনখারাপও।

সবুজ ধানখেতের পাশে বাঁশের খুটিতে আটকে রয়েছে গোটা চারেক টিন। বেদির বেশ কিছু অংশ জলের তোড়ে ভেঙে গিয়েছে। সেখানেই ফের মাটি লেপার কাজ চলছে। সেটাই রানিতলা চরের পুজো মণ্ডপ। গোপীনাথ মণ্ডল, পিন্টু মণ্ডলেরা সমস্বরে বলছেন, ‘‘পুজোর আগে আমাদের আর ডুব দিতে হয় না কর্তা। নদীই ডুবিয়ে দেয়। গঙ্গা নেই তো কী হয়েছে, পদ্মায় সই!’’

চর বাঁশগড়াতেও জোর ব্যস্ততা। বানের জলে ভেসে আসা খড়কুটো সরিয়ে সাফ করা হচ্ছে ইদগাহ। মঙ্গলবার সকালে সেখানেই নমাজ সারবে গোটা গ্রাম। নদিয়ার আদেরের মতোই আক্ষেপ করছেন চরের আতাহার শেখ, শিবরাম মণ্ডলেরা, ‘‘দাওয়াত পেয়ে ইদের সকালে যেমন আমরা ওপার বাংলায় চলে যেতাম। তেমনি মণ্ডপের কাজেও হাত লাগাতে রাজশাহি থেকে লোকজন আসত। পুজো কিংবা ইদ তখন আর নিয়মে বাঁধা থাকত না। পরবটাও আক্ষরিক অর্থে সর্বজনীন হয়ে উঠত।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন