বেলা করে বাজার গিয়ে খান কয়েক শুকনো ঝিঙে আর তস্য নির্জীব বেগুনের খোঁজ পেয়েছিলেন তিনি।
কত হে?
গামছার আড়াল থেকে দূরের গ্রাম থেকে গঞ্জে আসা চাষা যে দাম হেঁকেছিল, সস্তার খোঁজে আসা ভদ্রলোক খানিক থতমতই খেয়ে গিয়েছিলেন।
দাম শুনে আড় চোখে ঘড়ি দেখে মাঝ বয়সী সরকারি কেরানি বোঝার চেষ্টা করছিলেন— বাস্তবিকই দেরীটা তাঁর না সময়ের!
সময়ের। নাকের ডগায় ঝুলে রয়েছে জামাইষষ্ঠী, সঙ্গে দোসর, এক ফালি চাঁদের হাত ধরে রমজান মাস।
জোড়া ফলায়, গত দু’দিন ধরেই বাজার একেবারে উনপঞ্চাশ ডিগ্রিতে ফুটছে। নমুনা পেশ কিয়া যায়—
ম্লান পটল— ২৫ থেকে ২৮ টাকা, উচ্ছে-করলা— বিশ টাকা, কানা বেগুন— পঁচিশ, গাবলু-গুবলু বাচ্চার মতো কচি লাউ— গলা ঝেড়ে চাষি বলছেন, ‘পনেরোটা টাকায় নিয়ে যান’, তরুণী কোমরের মতো লতানে পুঁই, এই দু’দিন আগেও ছিল পাঁচ এখন দশ টাকা। ফল পট্টিতে লিচু ১৩০, আম হঠাৎ ছুঁয়েছে আকাশ, ৬০ কলা, মর্তমান চারটে বিশ এমনকী শসাও বিশ টাকায় বিকোচ্ছে রমজান মাসের গোড়ায়!
কৃষ্ণনগর থেকে বহরমপুর— মাঝবঙ্গের চেনা সদর বাজারে এমনই হাত পোড়া সব দাম। কেরানি থেকে সাবেক সাহেব— জামাইয়ের পাত সাজাতে, না হয় রমজানের রোজা রাখতে হিমসিম।
রমজানের বাজারে ফল অগ্নিমূল্য। ডোমকলে সাফিউল্লা ইসলামের তোলা ছবি।
কৃষ্ণনগরের পুরনো বাজারে চালানি মাছের আড়ালে লুকিয়ে রাখা একটা রুপোলি শস্য দেখে এগিয়ে গিয়েছিলেন এক ভদ্রলোক। শুনতে হল— ‘‘জামাই যে সে জিনিস নয় কাকু, খচ্চা করুন ইলিশ ঝেড়ে দেব!’’ ভদ্রলোক আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘কত?’’
শুনতে হল— পাক্ক সাতশো।
তা হলে, পাবদা না বলে গলদাটা এক বার দেখে নেবেন নাকি!
বাইরে ঠাঠা রোদ্দুর, তবু বাজারে জল-কাদাটা সম্বৎসরের ঠিকা নেওয়া। তা হোক, সে পথে পাজামা তুলে হেঁটে জেনেছিলেন শ’খানেক গ্রাম ওজনের গলদার দাম সাতশো, বাগদা সাড়ে তিনশো থেকে চারশো টাকা। সাইজের ফেরে দাম উঠছে-পড়ছে। আটপৌরে পাতলা পাবদা পাঁচ থেকে ছ’শো টাকা। ‘আস্ত চিতল একটু কমে দিচ্ছি’ বলে চেঁচাচ্ছিল যে মেছুনি তাঁর কাছে গিয়ে শোনেন ছ’শো টাকা কিলো। আর শুধু পেটি নিলে? মেছুনি পানের পিক ফেলে জানিয়েছেন, ‘‘সাড়ে আটশো গো বাবু।’’
এলআইসি-র এজেন্ট জামাইয়ের জন্য এতটা খরচ করতে গা করেননি। তাই পাঁঠাই শ্রেয় মনে করে সে পথে পা বাড়িয়েই থমকে যেতে হয়েছিল তাঁকে। খবরের কাগজে আলতা দিয়ে লেখা পাঁঠা পাঁচশো, রেওয়াজি খাসি সাড়ে পাঁচশো।
অগত্যা ব্রয়লারই ভরসা। তবে চেনা ছেলেটিও দাঁত বের করে জানিয়ে দিয়েছিল ‘‘ক’দিন ১৬০’র নীচে দিতে পারব না কাকু!’’
জামাইষষ্ঠীর বাজার ছেয়েছে তপ্ত ইলিশে। কৃষ্ণনগরে সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।
অভিজ্ঞতাটা প্রায় একইরকম হয়েছিল বিপ্লব শেখের। রোজার মাস পড়তেই বাড়ির সকলের জন্য চাট্টি ফল কিনতে বহরমপুরের ফলপট্টিতে পা দিয়েই তিনি আঁচ করেছিলেন ‘ভুল’ করে ফেলেছেন। কেমন?
বিপ্লবের কথায়, ‘‘আরে লিচু থেকে আম, কলা থেকে খেজুর— হাতে ছেঁকা লেগে যাচ্ছিল দাদা। শেষে বেরিয়ে এসে রাস্তার কল থেকে মুখে-চোখে জল ছিটিয়ে একটু স্বস্তি পেলাম।’’ কি কিনলেন তাবলে?
মোটরবাইকে স্টার্ট দেওয়ার আগে যুবক চুপি চুপি জানাচ্ছেন, ‘‘আর বলবেন না, শশা কিনে মুখ রক্ষা করছি দাদা!’ শুধু বহরমপুর কেন, কান্দির বাসস্ট্যান্ড, নতুনবাজার, কোর্ট বাজার বেলডাঙার রাস্তা উপচানো বাজারেও চেহারা কিছু অন্যরকম নয়।
দাম শুনবেন? আপেল পাক্কা দু’শো, একটু ইম্পোর্টেড তকমা আঁটা হলে সাড়ে তিনশো। বেলডাঙার হাকিমুদ্দিন সাহেব বলছেন, ‘‘বেদানার দাম শুনে বাস্তবিকই বেদনা হল গো!’’ ১৮০ টাকা। কালো আঙুর দু’শো টাকা।
তাহলে?
জোড়া শিঙ বাগিয়ে ধেয়ে আসছে দুই পাবর্ণ— জামাইষষ্টি আর ইদ। আর, হাঁসফাঁস করছে আম বাঙালি, গরমে নয়, দামে!