পোস্তে হলুদ দাও তুমি, শাকে কি দাও নুন

বিয়ে— দু’অক্ষরের ভারী নিবিড় শব্দটি ফিকে হয়ে না এলেও কোথায় যেন ছিঁড়ে গিয়েছে তার সংস্কার, রীতিনীতি, আদব কায়দা, পুরনো সেই বিয়ের সিপিয়া রঙের পথ ধরে হাঁটল আনন্দবাজার।কেউ শুকনো নিমপাতার কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাচ্ছেন। কেউ ভুরিভোজের পর পরম তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে জগৎ মারছেন। লজ্জাবতী লতার মতো মিইয়ে পড়া কন্যেকে জড়িয়ে নিয়ে খুব মৃদু পদক্ষেপে আবির্ভূত হলেন দিদিমা, বা ঠাকুরমার মতো কেউ।

Advertisement

অনল আবেদিন

বহরমপুর শেষ আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৭:২০
Share:

পশ্চিম আকাশে সূর্য হেলে পড়েছে, গোধুলিবেলা। অনেকে বলেন কনে দেখা আলো। খোলা উঠোনের মাঝে খান দশেক চেয়ার। সদ্য ভুরি ভোজ সেরে পান মুখে দিয়ে ছেলের বাড়ির লোকজন চেয়ারে হেলান দিয়েছেন।

Advertisement

কেউ শুকনো নিমপাতার কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাচ্ছেন। কেউ ভুরিভোজের পর পরম তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে জগৎ মারছেন। লজ্জাবতী লতার মতো মিইয়ে পড়া কন্যেকে জড়িয়ে নিয়ে খুব মৃদু পদক্ষেপে আবির্ভূত হলেন দিদিমা, বা ঠাকুরমার মতো কেউ। ষোড়শীর মাথায় উপর দিয়ে টেনে মুখের সামনে ঝুলছে দীর্ঘ ঘোমটা। আওয়াজ উঠল, ‘‘ঘোমটা খোল মা!’’ দিদিমা, বা ঠাকুরমা সম্পর্কীয় প্রৌঢ়া কিশোরীর মুখ থেকে ঘোমটাটা মাথার উপর তুললেন। আওয়াজ এল, ‘‘উঁহু! পুরোটা খুলতে হবে। মেয়ের চুল দেখতে হবে তো।’’ চুলের রং, গড়ন, গোছ ও দৈর্ঘ দেখার পর নির্দেশ দিলেন, ‘‘একটু হেঁটে এস তো মা!’’ ষোড়শী তার দিদিমা, ঠাকুরমাকে ধরে হাঁটতে শুরু করে। এ বার নির্দেশ, ‘‘উঁহু! একা হাঁটতে দিন।’’

খোঁড়া কিনা দেখার পর মেয়েকে বসতে বলা হল সামনের চেয়ারে। মেয়ের হাতের রং দেখে মুখের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া হয়। তার পর নিজের, বাবা-মায়ের, তিন পুরুষের, গ্রামের, পোস্ট অফিসের, থানার ও জেলার নাম জানতে চাওয়া হয়। ওই পর্ব শেষ হলে নাম সই করতে বলা হয় বাড়িয়ে দেওয়া খাতায়।

Advertisement

মুসলিম হলে নমাজ পড়ার সুরা মুখস্থ বলতে পারার পরীক্ষা নেওয়া হয়। হিন্দু হলে অঞ্জলি ও আহ্নিকের মন্ত্র জানে কিনা জানতে চাওয়া হয়। পরীক্ষার শেষ নেই যেন। বহরমপুরের কাটাবাগান এলাকার ষাটোর্ধ্ব মোশারফ হোসেন বলেন, ‘‘জানতে চাওয়া হয় শাকে ও আলুপোস্তে হলুদ দেওয়া হয় কিনা। ডালে কি ফোড়ন দেওয়া হয় জানেত চাওয়া হয়।’’ অনেক ক্ষেত্রে গান গাইতে পারার পরীক্ষাও নেওয়া হয়। অবশেষে ‘দর্শনী’র টাকা গুঁজে দেওয়া হয় মেয়ের হাতে।

ছেলের বাড়ি থেকে কতজন আসবেন, কখন আসবেন, কত বার খাবেন মেয়ের বাড়ির কর্তার কাছে তার একটা দীর্ঘ ফিরিস্তি ঘটকঠাকুর আগাম পেশ করতেন। সেই মতো হেঁশেল থেকে রাজকীয় রান্নার সুবাস ছড়াত বাড়িময়। মেয়ের কোনও ত্রুটি থাকলে মায়ের রান্নার স্বাদে পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা থাকত।

বালিরঘাটের পালপাড়ার ষাট ছুঁই ছুঁই অভিমুন্য পাল বলেন, ‘‘কনে দেখার আগেই ছেলে পক্ষ মেয়ে পক্ষের পুকুর, বাগান, বাঁশবন, খেতিজমি সরজমিনে দেখতেন।’’

নেট-দুনিয়ার দাপটে ছেলে-বাড়ির সেই সব ‘দৌরাত্ম্য’ হারিয়েছে খানিক। কিন্তু মন কি বদলেছে? প্রশ্নটা এখনও ঘুরপাক খায় গ্রাম-শহরে মেয়ে-বাড়ির দেওয়ালে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন