রাস্তা ফাঁকা, ভরা অফিস

সাতসকালেই বেরিয়ে পড়েছিল এক ঝাঁক বাইক। প্রযত্নে, জেলা তৃণমূল সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্ত। উদ্দেশ্য, নজরদারি। খান তিরিশ-পঁয়তিরিশ বাইকের একটির পিছনে গৌরীবাবু সওয়ার। সঙ্গে সওয়ারিদের মধ্যে চেনামুখ কিছু সমাজবিরোধীও। শুক্রবার কৃষ্ণনগর শহরের বিভিন্ন এলাকা জুড়ে চক্কর মারতে থাকে ওই বাহিনী।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০১:২৭
Share:

বন্‌ধের বিরোধিতায় কৃষ্ণনগরের রাস্তায় তৃণমূলের বাইক-বাহিনী। নেতৃত্বে গৌরীশঙ্কর দত্ত।

সাতসকালেই বেরিয়ে পড়েছিল এক ঝাঁক বাইক।

Advertisement

প্রযত্নে, জেলা তৃণমূল সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্ত। উদ্দেশ্য, নজরদারি।

খান তিরিশ-পঁয়তিরিশ বাইকের একটির পিছনে গৌরীবাবু সওয়ার। সঙ্গে সওয়ারিদের মধ্যে চেনামুখ কিছু সমাজবিরোধীও। শুক্রবার কৃষ্ণনগর শহরের বিভিন্ন এলাকা জুড়ে চক্কর মারতে থাকে ওই বাহিনী।

Advertisement

ইতিমধ্যে শিল্প ধর্মঘটের সমর্থনে পোস্ট অফিস মোড় থেকে মিছিল বের করেছিল ট্রেড ইউনিয়নগুলি। বিভিন্ন রাস্তায় ঘুরে ধর্মঘটের সমর্থনে প্রচার চালায় সেই মিছিল। ফোয়ারার মোড়ে গৌরীবাবুদের বাইক-বাহিনী তাদের মুখোমুখি হয়ে যায়। উত্তেজনা ছড়ায় খানিক। যদিও বাড়াবাড়ি হয়নি।

সরকারি কর্মীরা যাতে নিজেদের কর্মস্থলে যেতে পারেন, সে দিকে সতর্ক নজর রেখেছিলেন গৌরীবাবুরা। তাঁদের উপস্থিতিতেই রবীন্দ্রভবনের সামনে থেকে সরকারি কর্মীরা মিছিল করে জেলা পরিষদ অফিসে যান। জেলা পরিষদের কর্মীরা ভিতরে ঢুকে যান। বাকিরা মিছিল করে চলে যান জেলার প্রশাসনিক ভবনে।

প্রত্যাশিত ভাবে, এ দিন সরকারি দফতরগুলিতে উপস্থির হার অন্য দিনের তুলনায় বেশিই ছিল— প্রায় ৯৮ শতাংশ। প্রশাসনিক ভবনে সেটা আরও বেশি। মোট ৪৫৯ জনের মধ্যে হাজির ৪৫১ জন। জেলাশাসক সুমিত গুপ্ত বলেন, “অন্য দিনের তুলনায় এ দিন উপস্থিতির হার ছিল বেশি। যে আট জন অনুপস্থিত ছিলেন, তাঁরা আগে থেকেই ছুটিতে আছেন।” এ দিন গরহাজির হলে সরকার যে কড়া ব্যবস্থা নেবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে, তা কাজ করেছে সন্দেহ নেই।

তবে, ধর্মঘটের ভরা সংসারেও অফিস-কাছারি গমগম করলেও তাঁদের কিন্তু দেখা যায়নি, বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আর অনুযোগ-আবদার নিয়ে যাঁরা ওই কর্মী-কর্তাদের কাছে দিনভর ‘ঘ্যান ঘ্যান’ করেন! কেন? সহজ উত্তরটা আরও সহজ করে দিচ্ছেন এক আমলা— ‘‘গাঁ-গঞ্জ থেকে আসা ওই কর্মীরা গাড়ি-ঘাড়োটা পেলে তো আসবেন, রাজপতে যানবাহণ কোথায়!’’

তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি খোলা থাকলেও ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতির হার ছিল অন্য দিনের তুলনায় অনেকটাই কম।

ঘড়িতে ১০টা ৪৫। কৃষ্ণনগরের প্রশাসনিক ভবনে কাজ চলছে।

কেন্দ্রীয় নীতির বিরুদ্ধে দেশজোড়া এই শিল্প ধর্মঘটে যেখানে বেশি প্রভাব পড়তে পারত, তা জেলার এক মাত্র শিল্পা়ঞ্চল কল্যাণী। কিন্তু সেখানে প্রভাব প্রায় পড়েনি বললেই চলে। অন্য দিনের মতো শহরের প্রায় সব যানবাহন চলেছে। ধর্মঘট সমর্থকদের রাস্তাতেও বিশেষ দেখা যায় নি। ফলে শাসকদলের লোকেদেরও পথে নেমে ধর্মঘট ঠোকানোর দরকার পড়েনি। বরং ‘সিঙ্গুর দিবস’ পালনের জন্য সকাল থেকে রাস্তায় নেমেছিলেন তৃণমূর প্রচুর নেতা-কর্মী। বের করা হয় মিছিলও।

কল্যাণীর কারখানাগুলিতেও অন্য শ্রমিক ইউনিয়ন থাকলেও তৃণমূলের ইউনিয়নই শক্তিশালী। অভিযোগ, তারা আগে থেকেই ফতোয়া জারি করে রেখেছিল যাতে এ দিন হাজিরা স্বাভাবিক থাকে। তার জেরে বড় কারখানাগুলিতে হাজিরার হার প্রায় স্বাভাবিক ছিল। ফিনিক্স ইউল কারখানায় দু’টি শিফটেই জনা কয়েক শ্রমিক ছাড়া অনুপস্থিতি বিশেষ ছিল না। একই অবস্থা অ্যান্ড্রু ইউলেও। তবে ছোট কারখানাগুলিতে হাজিরার হার অন্য দিনের তুলনায় কম ছিল। ফলে সেগুলিতে উৎপাদন কিছুটা মার খেয়েছে। রাস্তায় লোকজন কম ছিল। বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের হাজিরা লক্ষ্যণীয় ভাবে কম ছিল। তবে সব সরকারি অফিসে উপস্থিতির হার ছিল স্বাভাবিক।

কৃষ্ণনগর শহরে দীর্ঘদিন ধরেই বন্‌ধ বা ধর্মঘট মানে একটা পড়ে পাওয়া ছুটির দিন। যে কেউ যে কোনও কারণে বন্‌ধ ডাকলেই এই শহরে তা সর্বাত্মক চেহারা নেয়। বন্ধ থাকে দোকান-বাজার। এ দিন কিন্তু সেই নিয়মে ছেদ পড়েছে। শহরের নানা এলাকায় বেশ কিছু দোকানপাট খোলা থাকতে দেখা গিয়েছে।

রাস্তায় দেখা গিয়েছে টোটো, অটো ও ম্যাজিক গাড়ি।

নিয়মমাফিক, সকালের দিকে কিছু রুটে কয়েকটি বাসও চলেছিল। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে তা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। নদিয়া জেলা বাসমালিক সমিতির পক্ষে অসীম দত্ত বলেন, “সকালের দিকে প্রায় পাঁচ থেকে আট শতাংশের মত বাস চলেছে। তবে রাস্তায় তেমন যাত্রী ছিল না। তাই পরে বাস চলেনি।” আইএনটিটিইউসি নেতা মিঠু শেখের দাবি, “কর্মীরা বাস চালাতে প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু তেমন যাত্রী না থাকায় নিয়মিত বাস চালানো যায়নি।”

তেহট্ট, বেতাই, নাজিরপুর ও করিমপুরেও বাস-ট্রাকের মতো বড় যান চলাচল করেনি। তবে ছোট-ছোট গাড়িতে যাত্রীরা যাতায়াত করেছেন। বেশ কিছু দোকানপাট খোলা ছিল। স্কুল, কলেজ, ব্যাঙ্ক ও অন্যান্য অফিস খোলা ছিল। যদিও ছাত্রছাত্রীদের অনুপস্থিতির কারণে বহু স্কুলে ক্লাস হয়নি। সকালে ধর্মঘটের সমর্থনে সিপিএম মিছিল বের করে। পাল্টা মিছিল করে তৃণমূল।

সিপিএমের তেহট্ট জোনাল সম্পাদক সুবোধ বিশ্বাসের দাবি, “মানুষ এই ধর্মঘট পুরোপুরি সমর্থন করেছেন। রাস্তায় যান চলাচল করেনি। ব্যবসায়ীরা দোকানপাট বন্ধ রেখেছেন। তৃণমূল জোর করে বিরোধিতা করলেও মানুষ তা প্রত্যাখ্যান করেছে।” করিমপুর ১ ব্লক তৃণমূল সভাপতি তরুণ সাহা পাল্টা বলেন, “কর্মনাশা ধর্মঘটের আন্দোলন মানুষ মেনে নেয়নি। এলাকার সব অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বেশির ভাগ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা ছিল। রাস্তায় ও বাজারে মানুষের যাতায়াত ছিল স্বাভাবিক।”

ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন