এমনই হাল ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের। বহরমপুরে গৌতম প্রামাণিকের তোলা ছবি।
পাড়ার রাস্তার হালও হয়তো এত খারাপ হয় না!
দিন কয়েক আগে ছেলেকে স্কুলে ছাড়তে গিয়েছিলেন বহরমপুরের তাপস মিত্র। বাসের জানলা দিয়ে তিনি মোটরবাইকের পিছনে বসে থাকা এক মহিলার মর্মান্তিক মৃত্যুর দৃশ্য দেখেছিলেন। আচমকা গর্তে পড়ে মোটরবাইকের চালক টাল সামলাতে পারেননি বলেই দুর্ঘটনাটি ঘটে। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া সেই দৃশ্যের কথা মনে পড়লে এখনও শিউরে ওঠেন তাপসবাবু।
শুধু তাপসবাবু নন, ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের বেহাল অবস্থার কারণে দুর্ঘটনার এমন অভিজ্ঞতা রয়েছে অনেকেরই। গত কয়েক মাসে দুর্ঘটনাও লাফিয়ে বেড়েছে। জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, জাতীয় সড়ক লাগোয়া বেলডাঙা, রেজিনগর, বহরমপুর, নবগ্রাম, সাগরদিঘি, রঘুনাথগঞ্জ, সুতি, সামশেরগঞ্জ ও ফরাক্কা থানায় গত তিন মাসে দু’শোরও বেশি পথ দুর্ঘটনা ঘটেছে। মৃতের সংখ্যা অন্তত ৮৭। আহত হয়েছেন প্রায় আড়াইশো জন। অথচ রাস্তা সারইয়ের জন্য কর্তৃপক্ষের কোনও পদক্ষেপ এখনও চোখে পড়েনি স্থানীয়দের।
দিন কয়েক আগে নবান্নে প্রশাসনিক বৈঠকে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের বেহাল দশা নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাস্তা সারানোর ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের উদাসীনতার অভিযোগে আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই হুঁশিয়ারিতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বেহাল রাস্তার হাল ফেরাতে এখনও পর্যন্ত কোনও আশার কথা শোনাতে পারেনি জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ। পুজোর আগে জাতীয় সড়ক সংস্কার হবে কিনা, তা নিয়েও ধন্দ কাটেনি।
জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের মালদহ ডিভিশনের প্রকল্প আধিকারিক সঞ্জীবকুমার শর্মা জানান, বহরমপুর ঢোকার মুখ থেকে খাগড়াঘাট রেলগেট পর্যন্ত প্রায় ১৩ কিমি জাতীয় সড়ক সংস্কারের জন্য সম্প্রতি দরপত্র ডাকা হয়েছে। আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর ওই দরপত্র খোলা হবে। তার পরে ওয়ার্ক অর্ডার দিয়ে জাতীয় সড়ক সংস্কারের কাজ শুরু হবে। তত দিন?
মুর্শিদাবাদের লোকনাথপুর থেকে ফরাক্কা পর্যন্ত জাতীয় সড়কের প্রায় ১৩০ কিলোমিটার রাস্তা মুর্শিদাবাদ জেলার অধীনে। তার মধ্যে বহরমপুর ঢোকার মুখে ভাকুড়ি মোড় থেকে চুঁয়াপুর-পঞ্চাননতলা মোড় হয়ে খাগড়া রেলগেট পর্যন্ত প্রায় ১৩ কিলোমিটার রাস্তার বেহাল অবস্থা। গোটা রাস্তা ছোটখাটো গর্তে ভরা। বিশেষ করে চুঁয়াপুর ও পঞ্চাননতলা মোড়ের মাঝে বিপজ্জনক গর্ত তৈরি হয়েছে। একই রকম বেহাল রেজিনগর থেকে বহরমপুরের উত্তরপাড়ামোড় হয়ে নবগ্রামের মেহেদিপুর পযর্ন্ত প্রায় ৩৫ কিলোমিটার রাস্তা।
এ দিকে, রুজির টানে এলাকার ছোট-বড় ব্যবসায়ীরা প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলতে বাধ্য হচ্ছেন। ইদের আগে এলাকার বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীরা যৌথ ভাবে জাতীয় সড়ক সংস্কারের দাবিতে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা রাস্তা অবরোধ করে প্রতিবাদে সামিল হন। খবর পেয়ে বহরমপুর থানার পুলিশ বাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছে অবরোধ তুলতে ব্যর্থ হন। পরে বহরমপুর ব্লক প্রশাসনের এক কর্তা গিয়ে জাতীয় সড়ক সংস্কারের আশ্বাস দেন।
স্থানীয় হোটেল ব্যবসায়ী অমিত সরকারের অভিযোগ, হোটেলের সামনের রাস্তায় বড় বড় গর্ত। বৃষ্টির জলে গর্ত বাইরে থেকে বোঝা যায় না। ফলে আচমকা লরি-বাসের চাকা পড়ে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। টুকটুক উল্টে পড়ে যাত্রীরা জখম হচ্ছেন। ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি হোটেলে আগতদের মধ্যেও আতঙ্ক তৈরি হয়েছে বলে অমিতবাবুর দাবি।
জাতীয় সড়কের বেহার দশার কারণে নিত্যযাত্রী থেকে পথচারী সকলেই তিতিবিরক্ত। ব্যাঙ্ক কর্মী সুজাতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘জাতীয় সড়ক যাত্রা এখন নরক যন্ত্রণার সামিল।’’ এ দিকে, পুজো দোরগোড়ায়। জোর ব্যস্ততা ব্যবসায়ী মহলে। তাই জাতীয় সড়কের হাল ফেরানো নিয়ে চিন্তিত বণিকসভা।
মুর্শিদাবাদ জেলা চেম্বার অফ কমার্সের যুগ্ম সম্পাদক স্বপন ভট্টাচার্য জানান, জাতীয় সড়কের বেহাল দশার কারণে চুঁয়াপুর, পঞ্চাননতলা ও মধুপুরের ব্যবসায়ীরা বিপদে পড়ছেন। ওই সব এলাকার ব্যবসায়ীদের বেচাকেনা লাটে উঠেছে। আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁর হুমকি, জাতীয় সড়ক দ্রুত সংস্কার করা না হলে কোর কমিটির বৈঠক ডেকে দ্রুত আন্দোলনে নামবেন।
জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের তরফে সঞ্জীববাবু জানান, বৃষ্টির কারণে রাস্তায় পিচের কাজ এখন করা সম্ভব নয়। তবে ১৩ কিমি রাস্তা সংস্কারের জন্য ১৫ কোটির দরপত্র ঘোষণা করা হয়েছে। তার মধ্যে বহরমপুরের চুঁয়াপুর থেকে পাঁচ কিমি রাস্তা ম্যাস্টিক রোড করা হবে। আশ্বাস তো মিলল, এখন দেখার কবে সেই কাজ শুরু হয়।
সহ প্রতিবেদন— সেবাব্রত মুখোপাধ্যায়।