সেতুতে ঝালাই নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন সাধন

আক্ষেপটা যাচ্ছে না। উঠোনে পা ঘষে করবী ফুঁসছেন, ‘‘এত দিন ধরে মানুষটা কোম্পানিতে কাজ করল, একটা কেউ ফোন পর্যন্ত করল না।’’ খানিক আগেই দেহ এসেছে। নিয়মরক্ষার ফুল, একটা নিভু নিভু ধূপ, আর করবী বলছেন, ‘‘মা গো মুখটা চেনাই যাচ্ছে না। চেনা লোকটা অচেনা হয়ে গেছে গো!’’

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:৪২
Share:

আক্ষেপটা যাচ্ছে না। উঠোনে পা ঘষে করবী ফুঁসছেন, ‘‘এত দিন ধরে মানুষটা কোম্পানিতে কাজ করল, একটা কেউ ফোন পর্যন্ত করল না।’’ খানিক আগেই দেহ এসেছে। নিয়মরক্ষার ফুল, একটা নিভু নিভু ধূপ, আর করবী বলছেন, ‘‘মা গো মুখটা চেনাই যাচ্ছে না। চেনা লোকটা অচেনা হয়ে গেছে গো!’’

Advertisement

গত বাইশ বছর ধরে উড়ালপুল তৈরির ওই হায়দরাবাদি সংস্থাতেই কাজ করতেন সাধন মণ্ডল (৪৩)। তবে দুর্ঘটনায় পরে তাঁকে আর কেউ মনে রাখেনি। স্ত্রী করবীর তাই আক্ষেপটা রয়ে গিয়েছে এ দিনও। বলছেন, ‘‘এ বার আমাদের কী হবে, ওরা কেউ ভেবে দেখেছে!’’ পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস সাধন যে প্রাণপাত করতেন পড়শিরাও তা জানাচ্ছেন।

সাধন মন্ডলের বাড়ি কালীগঞ্জের পাগলাচন্ডী গ্রামে। তিনি নির্মাণ শ্রমিক হিসাবে কাজ করতেন ওই সংস্থায়। পারিবারিক সূত্রে জানা গিয়েছে, এমনও হয়েছে কাজের চাপে দু’মাস বাড়িই ফিরতে পারল না। হোলির আগের রাতে বাড়ি এসেছিলেন সাধন। ছেলে-মেয়ে, ভাইপো-ভাইঝিদের সঙ্গে দোলের দিন হইহই করে ফিরে গিয়েছিলেন শনিবার। বলে গিয়েছিলেন, ‘‘দিন কয়েকের মধ্য়েই আবার পিরবেন গ্রামে।’’ করবী বলছেন, ‘‘এমন করে কেউ কথা দিয়ে যায়!’’

Advertisement

বৃহস্পতিবার টিভিতে খবরটা শোনার পর থেকেই গোটা পরিবারের মনে কু ডেকেছিল। দেরি না করে সাধনবাবুর মোবাইলে ফোন করেছিলেন করবীদেবী। বন্ধ ফোন। এরই মধ্যে সাধনবাবুর এক ভাইপোর কাছে ফোন আসে, ‘‘সাধনদাকে পাওয়া যাচ্ছে না।’’ এর বেশি আর শোনারও চেষ্টা করেননি কেউ। তাঁর ভাই যদুনাথ ভাইপো আর এক আত্মনীয়কে নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছিলেন। প্রথমে ট্রেন। তারপরে শিয়ালদহ থেকে ট্যাক্সি করে সোজা উড়ালপুলের কাছে। কিন্তু কে কার খবর দেবে?

সকলেই ব্যস্ত উদ্ধার কাজে। রাত সাড়ে বারটা নাগাদ এক পুলিশ কর্মী পরামর্শ দিয়েছিলেন হাসপাতালে গিয়ে খোঁজ নিতে। খুঁজতে খুঁজতেই শুক্রবার রাতে আরজিকর মোডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে পাওয়া গিয়েছিল তাঁকে। তবে, আহতদের তালিকায় নয়, মর্গের ঠাণ্ডা ট্রে-তে।

দাদার মৃতদেহ শানাক্ত করেছিলেন যদুনাথ। শুক্রবার ভোরে দেহ নিয়ে ফিরে এসেছেন তাঁরা।

যদুনাথ বলেন, ‘‘অভাবের সংসার। পরিবারটাকে দাঁড় করানোর জন্য সারাটা জীবন লড়াই করে গেছে দাদা। দুই-ছেলে আর বৌদি। সঞ্চয় বলতে কিছু নেই। জানিনা সংসারটার কি হবে।’’ তিনি বলেন,‘‘দাদা সঙ্গে যারা কাজ করত তাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি যে ওই সময় দাদা ওয়েল্ডিংয়ের কাজ করছিল। তখনই উড়ালপুলটা ভেঙে পড়েছে।’’

একটানা কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ্য হয়ে পড়েছেন স্ত্রী করবীদেবী। শোকস্তব্ধ হয়ে গিয়েছেন প্রায় পঁচাত্তর বছরের বৃদ্ধা মা শেফালী মন্ডল। অসুস্থ্য হয়ে পড়েছেন তিনিও। করবীদেবী বলেন,‘‘খবরটা শুনেই কেন জানিনা মনের ভিতরে কু ডাকছিল। ফোন করলাম। দেখি মোবাইলটা বন্ধ হয়ে আছে। আচ্ছা বলুনতো ঠিক কার জন্য এমন ভাবে চলে যেতে হল মানুষটাকে।’’ খবরটা শোনার পর বিকেল থেকে একে একে সাধনবাবুর বাড়িতে এসেছেন ভোট প্রার্তীরা। আস্বাসও দিয়ে গিয়েছেন ঢের। যা শুনে তাঁর বৃদ্ধা মা বলছেন, ‘‘মানুষটা যে চলে গেল আর আশ্বাস!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন