ওভারলোড হলে ভরসা মাস্টারদাই

লরি, ম্যাটাডর চালকদের থেকে নেওয়া টাকার ভাগ মোটর ভেহিকেলস বিভাগের ভিতরে বেশ কয়েক জনের কাছে পৌঁছে দিয়ে ওই মাস্টারমশাই ওভারলো়ডেড গাড়ি চলাচলের সবুজ সিগন্যালের ব্যবস্থা করেন!

Advertisement

মনিরুল শেখ

কল্যাণী শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০১৯ ০১:২৫
Share:

হোটেলে লেনদেন করতে ব্যস্ত মাস্টারদা। বুধবার। নিজস্ব চিত্র

তিনি বিজরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। হরিণঘাটা থানার বিরোহী-১ গ্রাম পঞ্চায়েতের চন্ডীরামপুরের বাসিন্দা। সবাই ডাকে, মাস্টারদা নামে। অভিযোগ, তাঁর অঙ্গুলিহেলনেই নদিয়ার অধিকাংশ রাস্তায় বেআইনি হওয়া সত্ত্বেও অতিরিক্ত পণ্যবোঝাই গাড়ি যাতায়াতের ছাড়পত্র পেয়ে যায়! মোটর ভেহিকেলস ইন্সপেক্টরদের অনেকের সঙ্গেই তাঁর দহরমমহরমের অভিযোগ। লরি, ম্যাটাডর চালকদের থেকে নেওয়া টাকার ভাগ মোটর ভেহিকেলস বিভাগের ভিতরে বেশ কয়েক জনের কাছে পৌঁছে দিয়ে ওই মাস্টারমশাই ওভারলো়ডেড গাড়ি চলাচলের সবুজ সিগন্যালের ব্যবস্থা করেন!

Advertisement

প্রতি সন্ধ্যায় বিরোহীর একটি হোটেলে জমিয়ে মাস্টারদা জহিরুল মণ্ডলের এই লেনদেনের সিন্ডিকেট চলে বলে অভিযোগ অনেক দিনের। তা নিজের চোখে দেখতে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ ওই হোটেলে যাওয়া হল। পাশের টেবিলে তত ক্ষণে কাগজপত্র নিয়ে হাজির মাস্টারদা ও তাঁর শাগরেদরা। একে একে আসছেন লরির মালিক ও কর্মচারীরা। মাস্টারদা তাঁদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে গুনে রাখছেন। তার পর ফোনে কাউকে জানিয়ে দিচ্ছে গাড়িগুলির নম্বর। প্লাস্টিকের ঝোলা থেকে একটি বড় খাতা বার করে লিখেও রাখছেন নম্বরগুলি।

নিজের চেয়ার থেকে উঠে মাস্টারদার পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞালা করলাম, কী হচ্ছে? একবার তাচ্ছিল্যের সঙ্গে মুখের দিকে তাকিয়ে মাস্টারদা বললেন, ‘‘ও সব বুঝবেন না। এটা গাড়ির কারবার। বালি-পাথরের গাড়ি তো এমনি এমনি রাস্তা দিয়ে যেতে পারে না। সেই গাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’’ খানিক পরে তাঁকে হোটেলের বাইরে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলা হল, ‘আমিও গাড়ির মালিক। বীরভূম থেকে পাথর আনি। ওভারলোডেড থাকে গাড়ি। রাস্তায় ঝামেলা হয়। আপনার সাহায্য চাই।’ মাস্টারদা বাড়ি কোথায় জানতে চাইলেন। ধুবুলিয়া থানা শুনে বললেন, ‘‘একটু দূর হয়ে যাচ্ছে। আমার মতোই ওখানে যে এই কাজ করে, তার সঙ্গে কথা বলুন।’’

Advertisement

এর পরেই নিজের সাংবাদিক পরিচয় তাঁকে জানিয়ে প্রশ্ন করা গেল, এক জন শিক্ষক হয়ে আপনি এই কাজ কেন করেন?

একটু থমকালেন। তার পরেই বললেন, ‘‘আরে এই ভাবেই তো গোটা মার্কেটটা চলছেন। বুঝতে পারছেন না?

কথায় কথায় জানালেন, পরিবহণ দফতরের কয়েক জনের সঙ্গে জোট বেঁধে টাকার বিনিময়ে ওভারলোডেড গাড়িকে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেন। ফি সন্ধ্যায় হোটেলে এসে লরি মালিককেরা মাস্টারদাকে টাকা দিয়ে যান। কোনও রাখঢাক না-করেই মাস্টারদা বলেন, ‘‘পরিবহণ দফতরের লোকজনকে গাড়ির নম্বর দিলেই সেই গাড়ি ওঁরা ছেড়ে দেন। কোনও ঝামেলা করেন না।’’ আরও বলেন, ‘‘আমি পাশের দুটি জেলা উত্তর ২৪ পরগনা ও হুগলির কাজও করি। আমারও গাড়ি রয়েছে। সেই সূত্রে এই লাইনটা পেয়েছে। বেথুয়াডহরিতে জাতীয় সড়কের উপর টোল আদায় শুরু হলে তো এটা আর করা যাবে না। তাই যে ক’দিন চলছে, চলুক।’’ এর পর মাস্টারদা হোটেলের পিছনের দরজা দিয়ে অন্ধকারে উধাও হয়ে গেলেন। টেবিল ভর্তি দু’হাজার,পাঁচশো টাকার বান্ডিল গুছিয়ে ব্যাগে ভরতে শুরু করলেন মাস্টারদার চ্যালারা। মাস্টারদার সঙ্গে হওয়া কথোপকথোনের পুরো রেকর্ড রয়েছে আনন্দবাজারের হাতে।

লরি মালিকদের একাংশ জানাচ্ছেন, ১০ চাকার গাড়িতে যত টন মাল আসার কথা, আদতে তার থেকে অনেক বেশি মাল আনা হয়। বীরভূম, বর্ধমান-সহ বিভিন্ন জেলা থাকে আসে বালি-পাথর। অতিরিক্ত মাল বোঝাই থাকলে গাড়ি ধরেন মোটর ভেহিকেলস ইন্সপেক্টররা। মাস্টারদাও এক সময় টাকা দিয়ে অতিরিক্ত মাল আনাতেন। তখনই পরিবহণ দফতরের কয়েক জনের সঙ্গে খাতিরের সূত্রপাত। তার জেরেই এমন রমরমে সিন্ডিকেট চালাচ্ছেন এখন।

মাস্টারদার সিন্ডাকেটের এক জন জানাচ্ছেন, শুধু বিরোহীতেই নয়। কখনও কল্যাণীর মোড়ে একটি হোটেলে আবার কখনও ওখানকার একটি চায়ের দোকানে বসে একই কাজ করেন আরও এক জন। তিনিও নদিয়ার পরিবহণ দফতরের বিভিন্ন অফিসের কিছু অফিসারের হয়ে তোলা তোলেন। তাঁকে টাকা দিলেও দিব্যি টালানো যায় ওভারলোডেড গাড়ি। এই গাড়ি চলাচলের ফলে ভরা শীতেও ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের বিভিন্ন জায়গায় রাস্তা ভেঙে গিয়েছে বলে অভিযোগ। জেলাশাসক সুমিত গুপ্ত অবশ্য বলেন, ‘‘ওভারলোডিংয়ের ব্যাপারে প্রশাসন ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি নিয়ে চলে। আমরা মাঝেমধ্যেই অভিযান চালাই। সিন্ডিকেট কোথায় চলে, তারা কী ভাবে ছাড়পত্র দেয় জানি না। আমাদের কাছে এ রকম কোনও অভিযোগ আসেনি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন