এরই নাম শেয়ালমারি নদী। ছবি: বিশ্বজিত্ রাউত।
দাস বাড়ির দিদিমা সরসীবালা ডোমকল থেকে শেয়ালমারি নদী পথে নৌকায় চেপে নবদ্বীপে গিয়েছিলেন তীর্থে। দাস পরিবারের বর্তমান প্রবীণ সদস্য শিশির দাস দিদিমার কোলে বসে সে গল্প বিশ্বাস করলেও দাস বাড়ির নতুন প্রজন্মের কাছে সেটা গল্প বলেই মনে হবে।
শিশিরবাবু দেখেছেন ভরা চৈত্রেও ওই নদী ছিল জলে ভরা। হাজার মনের বানিজ্যিক নৌকা ভেসে যেত।
সে সব কয়েক দশক আগের কথা। টানা এক দশক ধরে স্বার্থান্বেষী লোকজন ধীরে ধীরে দখল করে নিয়েছে সেই নদী। নদীর উপর তৈরি হয়েছে কংক্রিটের ব্রিজ। বাড়ি-ঘর, দোকানপাট। ফলে নদী এখন পরিনত হয়েছে খালে। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, যেভাবে নদী দখল হচ্ছে তাতে বছর কয়েকের মধ্যে শেয়ালমারি নামটার অস্তিত্বই আর থাকবে না। আর এর ফলে তৈরী হবে সঙ্কটও। কারণ, শহর বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে নিকাশি সমস্যা। তা ছাড়াও কৃষি প্রধান এই এলাকার আর্থ-সামাজিক অবস্থার উপরেও এই নদীর বড় প্রভাব ছিল।
এক সময় পদ্মার শাখানদী হিসেবে শেয়ালমারীর উত্পত্তি হয়। ডোমকলের কুপিলার কাছে নদী দু’টি ভাগে ভাগ হয়ে যায়। ডোমকলের দিকে একটি অংশ প্রবাহিত হতে থাকে। সেই অংশটি মূল নদী-শেয়ালমারি নামে পরিচিত। অন্য অংশটি নদিয়ার করিমপুর হয়ে হুলোরঘাটের কাছে গঙ্গায় মিশেছে। সেটি জলঙ্গি নামে পরিচিত। এক সময় ওই নদীতে সারা বছর ভরপুর জল থাকত। “চল্লিশ আগে স্নান করতে গিয়ে পা হড়কে জলে ডুবে যাওয়ার ভয়ে কাঠ হয়ে থাকতাম আমরা”, বললেন অমিয়বালা দাসী, রাজুবালা মিস্ত্রীরা। রাজুবালার কথায়, ‘‘বাসন পরিষ্কার থেকে স্নান ও কাপড় কাচা সবই হত নদীর জলে। বর্ষাকালে বাড়ির ছোটদের চোখে চোখে রাখতাম, পাছে জলে পড়ে না যায়। রাতে শুয়েও দাড় টানা নৌকার ছলাত্ ছলাত্ আওয়াজ আর মাঝিদের গান ভেসে আসত কানে।’’ বয়সের ভারে চোখ ধূসর হয়ে এলেও মনের চোখে ভরপুর নদীর ছবি এখনও স্পষ্ট অমিয়বালা দাসির। তার কথায়, ‘‘এক সময় বর্ষাকালে বন্যা এলেই নদী নিয়ে ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকতাম। ওই সময়ে নদীকে অনেক গালমন্দও করেছি। কিন্তু ভাবিনি বছর কয়েকে এমন অবস্থা হবে।’’
ডোমকল স্পোর্টিং ক্লাবের সম্পাদক দেবাংশু সরকার বলেন, ‘‘পূজোর সময়ে পরিষ্কার জল থাকত নদীতে। বিসর্জন দিয়ে সাঁতরে পাড়ে উঠতাম। আর এখন জলের অভাবে বিসর্জনই দিতে পারি না।’’
এক সময় এই নদীকে ঘিরে জলপথে চলেছে বাণিজ্য। নদীপথে যেমন যাওয়া যেত রাজশাহী, তেমনি কলকাতাও যাওয়া যেত অনায়াসে। বর্ষার সময় কলকাতায় কাঠ ও বাঁশ নিয়ে যাওয়া হত নদী পথেই। ফলে প্রবীণদের মুখে শেয়ালমারী নিয়ে হাজারও গল্প ঘুরপাক খায়। দাড়টানা নৌকা, পাল তোলা নৌকা থেকে গুন গুন করে গান গেয়ে গুনটানা নৌকার স্মৃতি। চাঁদনি রাতে মাছ ভেজে খাওয়া, কখনও খোল-করতাল নিয়ে আসরে বসে যাওয়া সবই ছিল নদীপাড়ে। পরিবারের আদি মুদির ব্যবসা সামলাতে নৌকায় মাঝে মাঝেই পাড়ি দিত বনেদি ব্যবসায়ী কালি মণ্ডল ওরফে কালু। সত্তরোর্ধ্ব কালুর কথায়, ‘‘বাবা কাকাদের কাছে শুনেছি এই নদীতে ষ্টিমারও চলেছে। পন্য পরিবহণের একমাত্র রাস্তা ছিল এই নদী। অথচ এখন সেই নদী আটকে গড়া হয়েছে পাকা সড়ক।’’ স্মৃতি হাতড়ে ডোমকলের বাসিন্দা শিশির দাস বলেন, ‘‘দিদিমার কাছে শুনেছি তিনি নবদ্বীপে তীর্থ করতে গিয়েছিলেন নৌকায় চেপে। প্রায় ১৫ দিনের যাতায়াতের পথে অনেক আত্মীয়দের বাড়িতে উঠেছিলেন বিশ্রাম ও কুশল বিনিময়ের জন্য। এখন সে সব ভাবতেও কষ্ট হয়।’’
ডোমকলের বাসিন্দা মতিউর রহমান বলেন, ‘‘নদীর এই হালের জন্য নাগরিক সমাজও অনেকটা দায়ী। আমাদের চোখের সামনে নদী দখল হলেও মুখ খুলিনি। সামান্য স্বার্থের জন্য আমরা এলাকার সব থেকে বড় সম্পদ এই নদীকে নষ্ট করেছি।’’
১০০ দিনের প্রকল্পে নতুন করে নদী সংস্কারের কাজ চলছে। ওই কাজ সন্তোষজনকভাবে ভাবে হচ্ছে না বলে অভিযোগ ডোমকলবাসীর। ডোমকল আজাদ ক্লাবের সম্পাদক তজিমুদ্দিন খান বলেন, ‘‘একটা নদী গোটা এলাকার ভারসাম্য রক্ষা করে। তাছাড়া যেভাবে শহর বাড়ছে তাতে এই নদী না থাকলে একদিন বড় বিপদের সামনে পড়তে হবে ডোমকলবাসীকে। আমরা চাই নদী তার গতি ফিরে পাক, আবারও নৌকা চলুক পাল তুলে।’’
নদী মজে যাওয়ায় সামাজিকভাবেও একটা বড় পরিবর্তন হয়েছে এলাকায়। এলাকার মত্স্যজীবীরা কাজ হারিয়েছেন। ডোমকলের মত্স্যজীবী রঞ্জন হালদার বলেন, ‘‘এখনও আমাদের লাখ টাকার নৌকা পুঁতে রয়েছে হাঁটু জলে। কী করব জল না থাকলে মাছ কোথায় হবে? অনেক মত্স্যজীবী পরিবার পেটের টানে পাড়ি দিয়েছে ভিন রাজ্যে।’’ মত্স্যজীবীদের মত মাছভাত প্রিয় বাঙালিও নদীর টাটকা মাছ থেকে বঞ্চিত। ডোমকলের বাসিন্দা এক্রামূল হক বলেন, ‘‘বছর কুড়ি আগেও এই নদীর সুস্বাদু মাছ বাজারে মিলত। সে সব এখন অতীত।’’ নদী মজে যাওয়ায় সেচের জন্য নদী থেকে জল থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন চাষিরা। নদীর দু’ধারে থাকা হাজার হাজার বিঘা জমি সেচের জন্য চাষিকে নতুন করে পাম্পসেট বসিয়ে চড়া দামে সেচ দিতে হচ্ছে।
চোখের সামনে ধীরে ধীরে স্রোতস্বিনী এই নদীর হারিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে ডোমকলের বিডিও রবীন্দ্রনাথ মিত্র বলেন, “অনেক জায়গায় নদী দখল হয়ে গিয়েছে। এমন অভিযোগ পেয়েছি। সেগুলি খতিয়ে দেখে কড়া পদক্ষেপ করা হবে।”