দেখুন বেঁচে আছি, ভাতার আর্জি বৃদ্ধের

বছর সত্তরের কৃষ্ণবাবু এক সময় কৃষ্ণনগর-১ পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য ছিলেন। তবে বর্তমান শাসক দলের নয়, সিপিএমের। ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি সরকারের বার্ধক্য ভাতাও নিয়মিত পেতেন। আচমকা এক দিন তা বন্ধ হয়ে যায়। খোঁজখবর করে জানতে পারেন, সরকারের খাতায় তিনি মৃত।

Advertisement

সুস্মিত হালদার

কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০১৭ ০৩:৪৮
Share:

কৃষ্ণ বাগ।— নিজস্ব চিত্র।

দম্বিনীকে মরে প্রমাণ করতে হয়েছিল সে বেঁচে ছিল।

Advertisement

জীবদ্দশায় নিজেকে জীবিত প্রমাণ করতে জুতোর সুকতলা প্রায় খুইয়ে ফেলেছেন ভীমপুরের কৃষ্ণ বাগ। প্রায় ৪০ মাস ধরে প্রশাসনের দরজায় দরজায় ঘুরছেন তিনি। আধিকারিকদের বলছেন, “এই দেখুন স্যার, আমি বেঁচে আছি। দিব্যি হেঁটে হেঁটে সশরীরেই অফিসে এসেছি!’’

বছর সত্তরের কৃষ্ণবাবু এক সময় কৃষ্ণনগর-১ পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য ছিলেন। তবে বর্তমান শাসক দলের নয়, সিপিএমের। ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি সরকারের বার্ধক্য ভাতাও নিয়মিত পেতেন। আচমকা এক দিন তা বন্ধ হয়ে যায়। খোঁজখবর করে জানতে পারেন, সরকারের খাতায় তিনি মৃত। কোনও রকমে দিন গুজরান করা কৃষ্ণবাবুর লড়াইটা সেই থেকে চলছে। পড়শিরা বলছেন, “তৃণমূলে নাম লেখালে ভাতাটা বেঘোরে মারা যেত না।”

Advertisement

কৃষ্ণবাবুর বাড়ি ভীমপুরের পোড়াগাছা গ্রামের সর্দারপাড়ায়। পাটকাঠির বেড়া আর টিনের চালের দু’কামরার ঘর। উঠোনের এক পাশে যে চালাঘরে রান্না হয়, তার চালের অর্ধেক ঝড়ে উড়ে গিয়েছে বছর দেড়েক আগে। অভাবের চিহ্ন ঘরময় ছড়িয়ে। রান্না ঘরের পিছনে বাঁধা একটা দুধেল গাই। এটাই তাঁর আয়ের একমাত্র উৎস। গরুর দুধ বেচেই কোনওরকমে সংসার চলে তাঁর।

কৃষ্ণবাবুর দুই ছেলে আর দুই মেয়ে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। ছোট ছেলে থাকে দিল্লিতে। একটা বেসরকারি স্কুলে কেরানির কাজ করেন। বড় ছেলে ট্রাক্টর চালাতেন। দুর্ঘটনার পরে তেমন কাজ করতে পারেন না। ছোট ছেলের নিজের সংসার থাকলেও সময়ে-অসময়ে তাঁর সাহায্যও ভরসা।

সিপিএম ক্ষমতা থেকে গিয়েছে অনেক দিন। তার পরেও পার্টির রক্তক্ষরণ চলছেই। পার্টির এই দুর্দিনে তিনি নিজে আজও সক্রিয় পার্টিকর্মী বলে গর্ব করেন। গরুর বিচালি কাটতে কাটতে তিনি বলেন, “প্রচণ্ড অভাবের মধ্যে দিয়ে বড় হয়েছি। রাজমিস্ত্রীর কাজ করতাম। ক্ষমতায় থাকার সময়ে কোনও দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিইনি। বার্ধক্যভাতাটা পেলে সংসারটা কোনওরকমে টানতে পারতাম।’’

১৯৯৮ সাল থেকে ২০০৩ পর্যন্ত তিনি পঞ্চায়েত কৃষ্ণনগর-১ পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য ছিলেন। ২০০৯ সাল থেকে বার্ধক্য ভাতা পাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু ২০১৪ সালে আচমকা তা বন্ধ হয়ে যায়। তিনি স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েতে যান। তাঁকে বলা হয়, টাকা বন্ধ করেছে ব্লক থেকে। তিনি ছুটে যান ব্লকে। বেশ কয়েকবার সেখানে গিয়েও শিকে ছেঁড়েনি। শেষে তথ্যের অধিকার আইনে জানতে পারেন, সরকারি খাতায় তিনি মৃত। ‘‘সব অফিসে নিজের সমস্ত পরিচয়পত্র সঙ্গে নিয়ে সশরীরে হাজিরা দিয়েও প্রমাণ করতে পারিনি আমি জীবিত’’— হতাশা ঝড়ে পড়ে কৃষ্ণবাবুর গলায়। সব শুনেও ‘সরকারি বাবুরা’ নড়েচড়ে বসেনি। কৃষ্ণনগর-১ ব্লক উন্নয়ন আধিকারিক শেখ আনসার আহমেদ বলেন, “পঞ্চায়েত মৃত বলে রিপোর্ট দিয়েছিল। তার ভিত্তিতেই কাটা গিয়েছে কৃষ্ণ বাগের নাম।” তিনি জানান, শুনানি করে জেলা প্রশাসনের কাছে পাঠানো হয়েছে, যাতে তার ভাতা আবার চালু হয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন