কাশ্মীরে ফিরে ভুল করে কথা বলি বাংলায়

চোদ্দো বছর বয়সে কাকার সঙ্গে শ্রীনগর থেকে কৃষ্ণনগরে শাল বিক্রি করতে এসেছিলেন গোলাম আহমেদ। তার পর কেটে গিয়েছে ছত্রিশ বছর। বছরের ছয় মাস তাঁর কাটে এই কৃষ্ণনগরেই। এই শহর আমাদের আর একটা বাড়ি —বলেন গোলাম।

Advertisement

সুদীপ ভট্টাচার্য 

কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:৫৩
Share:

ঘরের-মানুষ: হামলার ভয়ে বন্ধ হয়নি কাশ্মীরি শালওয়ালাদের দোকান।

চোদ্দো বছর বয়সে কাকার সঙ্গে শ্রীনগর থেকে কৃষ্ণনগরে শাল বিক্রি করতে এসেছিলেন গোলাম আহমেদ। তার পর কেটে গিয়েছে ছত্রিশ বছর। বছরের ছয় মাস তাঁর কাটে এই কৃষ্ণনগরেই।" এই শহর আমাদের আর একটা বাড়ি"—বলেন গোলাম।

Advertisement

কৃষ্ণনগরের সঙ্গে গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন গোলাম। নিজেই গর্বের সঙ্গে জানান, এখন তিনি ‘হাফ বাঙালি।’ কত লোকের সঙ্গে এখানে তাঁর আত্মীয়তা। বলেন, "কাশ্মীরে আমার যত পরিচিত, তার থেকেও বেশি পরিচিত লোক রয়েছেন কৃষ্ণনগরে। এ বছর অসুস্থতার জন্য কাকা আসতে পারেননি। কিন্তু ফোন করে চেনা পরিচিতের খোঁজ নিয়েছেন।"

কৃষ্ণনগর জেলা আদালতের পাশে সুপ্রমা মণ্ডলদের স্টুডিও-র একটা ঘর ভাড়া নিয়ে চল্লিশ বছর ধরে শালের দোকান চালাচ্ছেন গোলামের কাকা মেহেরাজ ডিন। সুপ্রমা বলেন, "বাবা বেঁচে থাকতে মেহেরাজ কাকাকে আমার নিজের কাকা বলেই চিনিয়ে গিয়েছেন। আর গোলাম হলেন আমার নিজের দাদা। কাশ্মীরে ওঁদের বাড়ি বিয়েতে আমরা সবাই মিলে গিয়েছি। ওঁরাও সকলে সাধ্যমতো আমাদের সব অনুষ্ঠানে আসার চেষ্টা করেন। সব সময় ওঁর পাশে আছি বোনের মতোই"।

Advertisement

রাস্তার উল্টোদিকেই ত্রিশ বছর ধরে শালের ব্যবসা করছেন মনজুর আহমেদ। বাড়ি কাশ্মীরের শ্রীনগরে। মনজুর বলেন, "এখানে এসেই বাংলা শেখা। বছরের অর্ধেক সময় কৃষ্ণনগরে থাকতে-থাকতে আমিও বাঙালি হয়ে গিয়েছি। কাশ্মীরে ফিরে অনেক সময় ভুল করে বাংলায় কথা বলে ফেলি। কাগজে দেখলাম, এক কাশ্মীরি শাল বিক্রেতাকে মারা হয়েছে। এত বছর এখানে আছি, কোনওদিন এমন শুনিনি।’’ তাঁর কথায়, ‘‘আমরাও ভারতীয় আর যারা হামলা চালালো তারাও ভারতীয়। সেই সূত্রে তো তারা আমাদের ভাই। এখানে সবাই এত ভাল যে এই ঘটনাটা বাড়িতে জানাতে নিজেরই লজ্জা হচ্ছে।"

পোস্ট অফিস মোড়ে শালের দোকান নূর মহম্মদের। নূর বলেন, ‘‘১৯৭৮ সাল থেকে কৃষ্ণনগরই আমার বাড়ি। কাশ্মীরের থেকে এখানে অনেক বেশি শান্তিতে বাস করি। কোনও দিন কোনও সমস্যায় পড়িনি।’’ নূরের দোকানের উল্টোদিকেই ছিট কাপড়ের ব্যবসা অরুণ দত্তের। বললেন, " ঊনত্রিশ বছর ধরে কাশ্মীর থেকে ফেরার সময় নূর আমাদের জন্য কাঠ বাদাম এনে দেন। কোনওদিন আনতে ভোলেননি। আমার দাদা যখন কাশ্মীর বেড়াতে গিয়েছিলেন তখন গাড়ি ভাড়া করতে দেননি নূর। নিজের গাড়িটা দিয়ে দিয়েছিলেন বেড়ানোর জন্য।"

শাল ব্যবসায়ী রুখসার আহমেদের বাড়ি কাশ্মীরের উড়ি-তে। গল্প শোনালেন, ‘‘একবার পেটে খুব যন্ত্রণা শুরু হল। এলাকার মানুষই আমায় হাসপাতাল নিয়ে গিয়ে সুস্থ করেন। কোনওদিন কোনও অসুবিধা হয়নি এত বছরে।" পোস্ট অফিস মোড়েই শালের ব্যবসা হারাধন মোদকের। সেই ব্যবসা সামলান বিল্লাল আর মুকতার নামে দুই কাশ্মীরি যুবক। হারাধন বলেন, ‘‘ওঁদের হাতে ব্যবসার দায়িত্ব দিয়ে আমি নিশ্চিন্তে থাকি।’’ নদিয়া জেলা চেম্বার অফ কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ-এর সম্পাদক গোকুল বিহারী সাহা-র কথায়, " ভারতবর্ষের সমস্ত লাইসেন্স-ধারী ব্যবসায়ীর পাশে আমরা আছি। কাশ্মীরি শাল বিক্রেতাদের ওপর আক্রমণ হলে আমরা তাঁদের পাশে দাঁড়াব।"

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন