হোমের আবাসিক কন্যার বিয়ে দিলেন কর্মীরাই

সকাল থেকে বক্সে বেজে চলেছে সানাই। হোমের রসুইখানা থেকে বের হচ্ছে মাংসের গন্ধ। অফিসঘরে ফুল দিয়ে সুন্দর করে তৈরি করা হয়েছে ছাদনা তলা। রঙিন কাগজে সাজানো হয়েছে হোম। হাতে মেহেন্দি মেখে নতুন পোশাকে ঘুরে বেড়াচ্ছে অন্য তরুণী আবাসিকেরা। গোটা বাড়িটায় খুশির হাওয়া।

Advertisement

সুস্মিত হালদার

কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০১৯ ০৩:০৬
Share:

বিয়ের সাজে মনীষা। নিজস্ব চিত্র

মনীষার চোখের কোণ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল জলের ফোঁটা। এত আনন্দে এ ছাড়া অন্য কোনও ভাবে বহিঃপ্রকাশ যেন হতেই পারে না। আজ যে তাঁর বিয়ে।

Advertisement

সকাল থেকে বক্সে বেজে চলেছে সানাই। হোমের রসুইখানা থেকে বের হচ্ছে মাংসের গন্ধ। অফিসঘরে ফুল দিয়ে সুন্দর করে তৈরি করা হয়েছে ছাদনা তলা। রঙিন কাগজে সাজানো হয়েছে হোম। হাতে মেহেন্দি মেখে নতুন পোশাকে ঘুরে বেড়াচ্ছে অন্য তরুণী আবাসিকেরা। গোটা বাড়িটায় খুশির হাওয়া।

সোমবার সকাল থেকে উপোস করেছেন হোমের পরিচালন সমিতির চেয়ারম্যান সুরঞ্জনা চক্রবর্তী। তিনিই কন্যা সম্প্রদান করবেন। সুরঞ্জনার সামনে চেয়ারে বসে আছেন পাত্রী মনীষা সরকার।

Advertisement

মাথাটা ঝুঁকে আছে মেঝের দিকে। বছর কুড়ির হোমের আবাসিক তরুণী বলছেন, “সেই ছোট্টবেলা থেকে হোমে আছি। ভেবেছিলাম এ ভাবেই বুঝি বাকি জীবন কেটে যাবে। আমার নিজের সংসার হবে, এটা ভাবতেই পারছি না।”

১৯৫৪ সালে গঠিত হয়েছিল ওয়েস্ট বেঙ্গল স্যোশাল ওয়েলফেয়ার বোর্ড। কৃষ্ণনগরের পঙ্কজ আচার্য মহিলা নিবাস এই হোম দ্বারা পরিচালিত। এত বছরে এই প্রথম কোনও মেয়ের বিয়ে দিতে পারছেন তাঁরা। কর্মী থেকে শুরু করে বোর্ড সদস্য সকলেই ভীষণ ভাবে উত্তেজিত। সঙ্গে তুমুল ব্যস্ততা। অতিথি আপ্যায়নে যেন এতটুকু খামতি না থাকে।

পরিচয়হীন মনীষা তাঁদের সকলের আদরের মেয়ে। সুরঞ্জনা বলছেন, “একটা মেয়েকে এ ভাবে নতুন জীবন দিতে পেরে কী যে আনন্দ হচ্ছে, বোঝাতে পারব না। সব খরচ বহন করছেন আমাদের কর্মীরা। নিজের থেকেই সকলে এগিয়ে এসেছেন।”

হোম সূত্রে জানা গিয়েছে, মনীষার পারিবারিক পরিচয় জানা নেই কারও। খুব ছোট থেকেই তিনি হোমের বাসিন্দা। প্রথমে বীরভূমের ‘শান্তিবাড়ি’। সেখান থেকে বহরমপুরের ‘শিলায়ন’ হোম। ২০১৭ সালে সেখান থেকেই মেয়েটি মাধ্যমিক পরীক্ষা দেন। পেয়েছেন কন্যাশ্রীর টাকা। কিন্তু বয়স আঠারো বছরের বেশি হয়ে যাওয়ায় ওই বছরই তাঁর নতুন ঠিকানা হয় কৃষ্ণনগরের এই হোম। তবে, মনীষার মিষ্টি ব্যবহারের কারণেই অতীতের হোমের কর্মীরা তাঁকে ভুলতে পারেননি। হোমের কর্মী রিক্তা দাসের কাছে যখন খবর আসে, বহরমপুরের সুতিরমাঠের এক যুবকের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখা চলছে, তখন তিনিই এগিয়ে এসে প্রস্তাবটি দেন। শারীরিক ভাবে সামান্য প্রতিবন্ধী বিলাবল গোস্বামীর পরিবার প্রস্তাব শুনে আগ্রহ দেখায়। শুরু হয় দেখাশোনা। বছর চব্বিশের বিলাবলকে নিয়ে আসা কৃষ্ণনগরের হোমে। দু’জনে বিয়েতে সম্মতি দেওয়ার পরেই শুরু হয় বিয়ের প্রস্তুতি। বিয়ের জন্য মনীষা পেয়েছে রূপশ্রীর টাকা। আর্থিক ভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন মন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাস ও সাধন পান্ডে। সোমবার বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে নব দম্পতিকে আশীর্বাদ করেন উজ্জ্বল বিশ্বাস। তিনি বলেন, “এই দৃষ্টান্তগুলি আরও বেশি বেশি করে সামনে আসুক। তাতে সামাজিক জড়তাগুলি ভেঙে যাবে।”

সন্ধ্যে পাঁচটায় লগ্ন। তার অনেক আগেই কুড়িজন বরযাত্রী নিয়ে হাজির বিলাবল। লাজুক মুখে বিলাবল বলছেন, “আমি প্রথমেই মনীষার কাছে জানতে চেয়েছিলাম যে, ও রাজি কিনা। সম্মতি পাওয়ার পর এগিয়েছি।” আর বিয়ের অনুষ্ঠানে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে বিলাবলের মা পূর্ণিমা গোস্বামী বলছেন, “আমার ছেলে সুখে আছে, এটাই দেখতে চাই। আর কোনও কিছুই গুরুত্বপূর্ণ নয়।”

বিলাবল-মনীষার চোখে ততক্ষণে নতুন জীবনের আলো জ্বলে উঠেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন