হারানো গরম-২: ‘নকশা করা পাটি বুনতেই পারি, কিন্তু কিনবে কে’

ঠান্ডা-যুদ্ধে হেরেই গেল শীতলপাটি

সম্রাট ঔরঙ্গজেব তখন দিল্লির মসনদে। তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী দিল্লি যাবেন সুবে বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ। জরুরি প্রয়োজন, কিন্তু এক বিশেষ কারণে কেবলই পিছিয়ে যাচ্ছে তাঁর যাত্রার দিন। আসলে সম্রাটের সঙ্গে দেখা করতে গেলে উপঢৌকন নিয়ে যাওয়াই প্রথা।

Advertisement

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২২ মে ২০১৭ ১০:৫০
Share:

বাজার-গরম: বিকোচ্ছে পাটি। ধুবুলিয়ায়। নিজস্ব চিত্র

সম্রাট ঔরঙ্গজেব তখন দিল্লির মসনদে। তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী দিল্লি যাবেন সুবে বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ। জরুরি প্রয়োজন, কিন্তু এক বিশেষ কারণে কেবলই পিছিয়ে যাচ্ছে তাঁর যাত্রার দিন। আসলে সম্রাটের সঙ্গে দেখা করতে গেলে উপঢৌকন নিয়ে যাওয়াই প্রথা। কিন্তু নবাব শুনেছেন ধর্মপ্রাণ ঔরঙ্গজেব দিল্লিশ্বর হয়েও সাধারণ জীবনযাপন করেন। তাঁর জীবনে বিলাসিতার স্থান নেই।

Advertisement

এ হেন সম্রাটের উপযুক্ত উপহার হিসেবে মুর্শিদকুলি খাঁ অনেক ভাবনাচিন্তা করে শেষপর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন রূপালি বেতের শীতলপাটি। কথিত আছে উপহার এতই পছন্দ হয়েছিল সম্রাটের যে তিনি নাকি আমৃত্যু শীতলপাটি পেতেই নমাজ পড়তেন।

মোঘল সম্রাট থেকে রানী ভিক্টোরিয়া, শীতলপাটির প্রেমে পড়া ব্যক্তিত্বের তালিকা দীর্ঘ। গরমের প্রাণান্তকর দুপুরে মেঝের উপর কিংবা দুঃসহ রাতে বিছানায় শীতলপাটি বিছিয়ে নিশ্ছিদ্র নিদ্রার অভ্যাস গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলের বাসিন্দাদের বহুকালের। গ্রামের মাটিলেপা দাওয়ায় ঘুমের বিছানার উপকরণ ছিল ওই শীতলপাটি কিংবা কাঠির মাদুর। ছেলেভুলানো ছড়ায় ঘুমপাড়ানি মাসিপিসিকে “শীতলপাটি পেড়ে দেব” এই শর্তেই ডাকা হতো।

Advertisement

আটের দশক অবধি গরমের দুপুরে শীতলপাটি পেতে হাতপাখা ঘুরিয়ে হাওয়া খেতে খেতে গরমের দুপুর পার করে দিতেন শহরগ্রামের মানুষ। তার পর দ্রুত বদলে যেতে লাগল জীবনযাপনের অভ্যাস। পাটি বা মাদুরের জায়গায় বাজারে এল রঙিন শতরঞ্চি, চাদর, বেডকভার। ছাপোষা গৃহস্থের ঘরেও তক্তপোশ সরিয়ে জায়গা করে নিল খাট, ডিভান, সোফা কাম বেড। শীতলপাটির দিন ফুরালো।

নবদ্বীপের প্রবীণ ব্যবসায়ী সমীরকুমার মিত্র জানান, “সত্তরের দশকে আমি যখন সবে ব্যবসা শুরু করেছি। তখন ১০ থেকে ১৫ টাকার মধ্যে শীতলপাটি মিলত। চৈত্র থেকে ভাদ্র মাসের মধ্যে কয়েকশো পাটি বিক্রি করতাম। অসম, কোচবিহার ও মেদিনীপুর থেকে আসত পাটি। বাংলাদেশ থেকে আসা শীতলপাটির দাম ছিল আকাশছোঁয়া। এখনও গ্রামের মানুষ পাটি ব্যবহার করেন। কিন্তু শহরে পাটি মণ্ডপ সাজানোর উপকরণ হয়ে উঠেছে।”

একই কথা বলেন মুর্শিদাবাদ বেলুল গ্রামের সুরবান বিবি, নুরবানু বিবিরা। গোটা গ্রামের সব ঘরেই মহিলারা পাটি তৈরি করেন। কিন্তু তাঁদের হাতে তৈরি তাল কিংবা খেজুর পাটির ক্রেতা এখন গ্রামের মানুষ। পাঁচ বাই সাতের একটা পাটি সাড়ে চারশো থেকে পাঁচশো টাকার মধ্যে বিকোয়। তাঁদের আক্ষেপ পাটির উপর সুতোর বাহারি নকশা এখন আর বুনতে পারেন না বলে। হাজার টাকা থেকে দাম শুরু। সুরবান বিবির প্রশ্ন, “বুনতেই পাড়ি কিন্তু কিনবে কে?”

অথচ একসময় অতিথি আপ্যায়ন থেকে বিয়ের আসর, নকশাদার শীতলপাটি নিয়ে ছড়ার শেষ নেই। ‘কুটুম এলো, কুটুম এলো, ঝেড়ে ধুলো-মাটি। দাও বিছিয়ে চিকন বেতে তৈরি শীতলপাটি।’ পাত্রপক্ষের কাছে মেয়ের গুণকীর্তন করতে গিয়ে বলা হচ্ছে “আর মাছ বানাইতো কন্যা, লয় ছালি-মাটি। ইলিশ বানাতো কন্যা, বিছায় শীতল পাটি”।

এই প্রজন্মের ব্যবসায়ী সৌরভ মিত্র বলেন, “১০০ টাকায় প্ল্যাস্টিকের মাদুর মেলে। পাটির কদর করবে কে?” তার মতে ঠান্ডা-যুদ্ধে এসি-র সঙ্গে শীতলপাটির পেরে ওঠা মুশকিল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন