এ পুজোর অতীতে লুকিয়ে রক্তের দাগ

তাদের সঙ্গে উকিলপাড়া বারোয়ারির চরম রেষারেষি। বিসর্জনের শোভাযাত্রা বার করেছে আরাধনা ক্লাব। আচমকা শুরু হল ইটবৃষ্টি। সঙ্গে লাঠি। মুহূর্তের মধ্যে গোটা এলাকা ফাঁকা। দর্শনার্থীরা সকলে প্রাণভয়ে ছুটছে। শুধু রাস্তার উপরে পড়ে আছে দুই পক্ষের রক্তাক্ত কয়েক জন যুবক!  

Advertisement

সুস্মিত হালদার

কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৮ ০৭:৪০
Share:

—প্রতীকী ছবি।

সত্তরের দশক। নিজেদের মধ্যেই নানান মনমালিন্য। তাই উকিলপাড়া বারোয়ারি থেকে বেরিয়ে এলেন কয়েক জন যুবক। তাঁরা জজকোর্টপাড়ায় শুরু করলেন আলাদা জগদ্ধাত্রী পুজো। ক্লাবের নাম দেওয়া হয়েছে আরাধনা।

Advertisement

তাদের সঙ্গে উকিলপাড়া বারোয়ারির চরম রেষারেষি। বিসর্জনের শোভাযাত্রা বার করেছে আরাধনা ক্লাব। আচমকা শুরু হল ইটবৃষ্টি। সঙ্গে লাঠি। মুহূর্তের মধ্যে গোটা এলাকা ফাঁকা। দর্শনার্থীরা সকলে প্রাণভয়ে ছুটছে। শুধু রাস্তার উপরে পড়ে আছে দুই পক্ষের রক্তাক্ত কয়েক জন যুবক!

কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজো এমনই অজস্র ঘটনা বহন করে নিয়ে চলেছে। পাড়ায় পাড়ার রেষারেষি, উঠতি দাদাদের শক্তি প্রদর্শন, খেলার মাঠের গন্ডগোল, ত্রিকোণ প্রেমের কাহিনি, রাজনৈতিক ক্ষমতার মতো নানা ঘটনা, নানান শত্রুতার ‘বদলা’ নেওয়ার মুক্তাঞ্চলে যেন পরিণত হত কৃষ্ণনগরের রাজপথ।

Advertisement

রাজআমল থেকে চলে আসা সেই ছায়াকে যেন আজও বহন করে চলেছে এই শহর। জগদ্ধাত্রী পুজো তাই এখানে শুধু উৎসব নয়, এর সঙ্গে লেগে আছে রক্ত, হিংসা আর বিদ্বেষের অতীত। লেগে আছে শুকনো চোখের জলের দাগ।

রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলনের উদ্দেশ্য নিয়ে মতপার্থক্য থাকলেও এই পুজোয় যে তিনিই প্রাণপুরুষ, সে বিষয়ে প্রায় সকলেই একমত। তিনি যখন কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন করেন, তখন অবশ্য কৃষ্ণনগরে বারোয়ারি সংস্কৃতি শুরু হয়ে গিয়েছে। শহরের বুকে তৈরি হয়েছে একাধিক বারোয়ারি। কথিত আছে, এমন একটি বারোয়ারির সঙ্গে তিনি নিজেই জড়িয়ে ছিলেন। অনেকেই মনে করেন, তাঁরই উৎসাহে এই সব বারোয়ারি মেতে উঠেছিল জগদ্ধাত্রী পুজোয়।

কৃষ্ণনগরের প্রাচীন জনপদগুলির অন্যতম গোয়াড়ির গোলাপট্টি, মালোপাড়া, বাঘাডাঙা, চকেরপাড়া, নেদেরপাড়া, ষষ্ঠীতলা, চাষাপাড়া এলাকা। উকিলপাড়া অপেক্ষাকৃত নবীন হলেও শহরের অন্যতম পুরনো জনপদ। এই জনপদগুলোর মধ্যে ছিল আত্মাভিমান। অনেকে মনে করেন, এই আত্মাভিমানের সঙ্গে জগদ্ধাত্রী পুজোর পদ্ধতি ও তাকে ঘিরে থাকা আচার এই প্রাচীন রেষারেষির অন্যতম কারণ।

কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজো সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী হয় একই দিনে। নবমী পুজো হয় তামসিক ভাবে, যেখানে থাকে মদ ও মাংস। আর ছিল নবমী পুজোর পরে ঢাক-ঢোল সহযোগে এক পাড়া থেকে অন্য পাড়ায় যাওয়া।

কৃষ্ণনগরের প্রবীণ নাগরিক সুবীর সিংহরায় বলছেন, “প্রথম দিকে এই নবমী পরিক্রমা ছিল সৌভ্রাতৃত্বের। কিন্তু পরবর্তী কালে সেটা আর থাকল না। কারণ, তামসিক পুজোর অন্যতম বিষয় ছিল মদ আর মাংস। পরের দিকে অনেকেই অপ্রকৃতিস্থ থাকত। সেই সঙ্গে ঢাকের বাদ্যি। ফলে, একটা উগ্রভাব চলে আসে।”

তাঁর মতে, ঠোকাঠুকি থেকে অশান্তির সূচনা হতে থাকে। আর নবমীর রাতের গন্ডগোলের রেশ এসে পড়ে শোভাযাত্রায়। শহরের প্রবীণ নাগরিকদের অনেকেই মনে করেন, কৃষ্ণনগরের পুরনো জনবসতি বা পাড়ার মধ্যে জগদ্ধাত্রী পুজোর ভাসানকে ঘিরে রেষারেষির সূচনা সেই থেকেই। এর পিছনে কাজ করত নিজের পাড়া বা জনপদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের তাগিদ। যার রেশ অনেকটাই বহন করে চলেছে বর্তমান প্রজন্ম।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement